Print Date & Time : 24 July 2025 Thursday 12:21 am

জনস্বার্থে খাদ্যের মান ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে

মাহমুদুল হক আনসারী: সুষম খাদ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নাগরিকের স্বাস্থ্যসম্মত জীবন অতিবাহিত করতে খাদ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সাংবিধানিক দায়িত্ব। খাদ্যের মান রক্ষার জন্য যথাযথ মনিটরিং রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সমাজে বিভিন্ন পেশা ও শ্রমের মানুষের বসবাস। খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ জীবিকার সন্ধানে

বাসাবাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। অফিস-আদালত ও কোর্টকাচারিতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের কর্মব্যস্ততা থাকে। ফলে এসব কর্মময় মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে হোটেল-রেস্টুরেন্টের শরণাপন্ন হয়।

টং দোকান থেকে আভিজাত রেস্টুরেন্ট বা হোটেল যেখানেই হোক খাদ্যের জন্য মানুষকে যেতে হয়। কিন্তু সে স্থানগুলোয় এসব খাদ্যের তৈরি, পরিবেশন ও দাম-মান নিয়ে অভিযোগের শেষ থাকে না। পচা-বাসি খাবার থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নমানের ময়দা ও মেয়াদোত্তীর্ণ পোড়া তেল ব্যবহার করে এসব খাদ্য জনগণকে খাওয়াতে দেখা যায়। ওপরে চাকচিক্যপূর্ণ রেস্টুরেন্টের নামডাক থাকলেও ভেতরে ভেজালে  ভরপুর। নিম্নমানের আটা ময়দা দিয়ে পোড়া তেলে ভাজা ফাস্টফুড ছাত্র থেকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে চড়া দামে খাওয়ানো হয়। এসব নাস্তার আইটেমের নামে ভিন্নতা থাকলেও দামের মধ্যে চড়া তফাত দেখা যায়।

গরু, মুরগি ও খাসির মাংসের মধ্যে বিরাট ভেজাল এখানে লক্ষ করা যায়। চড়া দাম দিয়ে খেতে হয় জনগণকে। ফার্মের মুরগির কেজি ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে হলেও হোটেলে ছোট আকারের দুই টুকরা মুরগির মাংস সাধারণ হোটেলে দাম নেওয়া হয় ১০০ টাকা। আর যদি সেটা দেশি মুরগি হয় তাহলে সেক্ষেত্রে তার মূূল্য বেড়ে হবে ২০০ টাকা। গরুর মাংসের কথা বলে মহিষের মাংস বিক্রি করার নজির অহরহ। সেক্ষেত্রে মাত্র ছোট ছোট ছয় টুকরা গরুর মাংসের দাম নেওয়া হয় ১৫০ টাকা। এভাবে অন্যান্য যেসব খাবার হোটেল-রেস্টুরেন্টে পরিবেশন করা হয়, সবগুলোর দাম প্রায় তিনগুণ বলা যায়।

একটা রেস্টুরেন্টের মূূল্যতালিকার সঙ্গে আরেকটির মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ইচ্ছামতো দাম নিয়ে জনগণের পকেট কাটা অব্যাহত আছে। মাছ-মাংস পরিবেশনে ব্যাপকভাবে ভেজাল কারচুপি অহরহ চলছে। সাধারণ মানুষ সাধারণ খাদ্য রেস্টুরেন্টে সাধারণভাবে খেলেও তার ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দরকার হয়। কিন্তু যে খাদ্য কোনো মানুষ হোটেল থেকে গ্রহণ করেছে, তার মূল্য ৪০ টাকার ওপরে আসার কথা নয়।

এভাবে হোটেল-রেস্টুরেন্টে পচা-বাসি খাবারের সঙ্গে যে পরিমাণ দাম হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে, তা যেন দিব্যি চোখ বুজে আমরা গ্রহণ করে যাচ্ছি। শ্রমজীবী-পেশাজীবী থেকে ভিআইপি মানুষও এসব হোটেল-রেস্টুরেন্টের অথবা ফাস্টফুড দোকানের খাবার গ্রহণ করে যাচ্ছে। কিন্তু এসব খাবারের মান আর মূল্য নিয়ে কারও বাদ-প্রতিবাদ নেই বললেই চলে। যা রেস্টুরেন্টের মালিকরা চায় তা-ই দিয়ে জনগণ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ে। কেন এত দাম নেওয়া হয়, একবারের জন্য কোনো রেস্টুরেন্ট গ্রাহককে তা বলতে দেখা যায় না।

যারা নিয়মিতভাবে রেস্টুরেন্টে খেয়ে জীবনজীবিকার সন্ধান করে, তাদের জন্য এ মূল্য অনেক কঠিন ও কষ্টকর। কিন্তু  যারা মাঝেমধ্যে রেস্টুরেন্টের শরণাপন্ন হয়, তাদের কথা না চিন্তা করলেও যাদের নিয়মিত রেস্টুরেন্টের খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়, অবশ্যই তাদের জন্য সমাজকে চিন্তা করতে হবে। এসব রেস্টুরেন্টের খাদ্য তৈরি, বিক্রিসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বিবেচনা করে মূল্য নিলে কোনো সমালোচনার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত মূল্য নিয়ে জনগণের পকেট কাটা কোনো অবস্থায় মেনে নেওয়া যায় না। এসব বিষয় গুরুত্বসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজর দেওয়া দরকার আছে।

শুধু রেস্টুরেন্টের কথা কেন, হাটবাজারের কথাও চিন্তা করতে হবে। মুদির দোকান থেকে ওষুধের দোকান পর্যন্ত কেউই সঠিকভাবে শৃঙ্খলামতো ব্যবসা করছে না। একই চাল পাশাপাশি দুটি দোকানে ২০০ টাকার পার্থক্যে বিক্রি করা হয়। এক দোকানে একই চাল এক হাজার ৮০০ টাকা হলে পাশের দোকানে সেই চাল দুই হাজার টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। মূল্যহীন প্যাকেটজাত খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্যান্য খাদ্যপণ্য এভাবে ইচ্ছামতো দাম দিয়ে বিক্রি করতে অনেক হাটবাজার ও দোকানে দেখা যায়।

সারা দেশে এখন পেঁয়াজের মহামারি চলছে। পত্রিকার সংবাদে দেখা যায়, প্রতিদিন বিভিন্ন দেশ থেকে টনে টনে পেঁয়াজ দেশে ঢুকছে। কিন্তু পেঁয়াজ ধীরে ধীরে গ্রাহকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। লেখাটি যখন লিখছিলাম তখন পেঁয়াজের খুচরা বাজারে মূল্য ছিল কেজিপ্রতি ১২০ টাকা। আবার সেটা সব দোকানদার একই দামে বিক্রি করছে না। কোনো কোনো দোকানদারকে ৯০-৯৫ টাকায়ও বিক্রি করতে দেখা গেছে। তাহলে আসলে কোন জায়গায় পেঁয়াজের সংকট, সেটা ভোক্তারা বুঝে নিতে পারছে না।

পেঁয়াজসহ খাদ্যদ্রব্যের বাজার আসলে কারা নিয়ন্ত্রণ করে, সেটাও খুঁজে পাচ্ছি না। এসব মৌলিক নাগরিক অধিকার নিয়ে যেভাবে ইচ্ছামতো কারসাজি হচ্ছে, সেটা কোনো অবস্থায় মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের এত সংস্থা থাকা সত্ত্বেও কেন জনগণের মৌলিক অধিকার খাদ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, সেটা বোধগম্য নয়। কোথায় সিন্ডিকেট, কোথায় কারসাজি, সেটা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে খুঁজে বের করতে হবে।

এত পেঁয়াজ দেশে ঢুকছে কোথায় গিয়ে এগুলো গুদামজাত হয়, তাও রাষ্ট্রকে খবর রাখতে হবে। জনগণের জীবন রক্ষা করা তাদের খাদ্যের পর্যাপ্ত অধিকার নিশ্চিত করা শাসকদলের অন্যতম দায়িত্ব। জনগণের রুজি-রোজগারের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব দেখতে হবে। আয়-ব্যয় যথাযথভাবে করতে না পারলে সেখানে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। সুতারাং খাদ্যের মান-মূল্য সবকিছু সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে।

গবেষক, প্রাবন্ধিক

mh.hoqueansari@gmail.com