জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষায় পরিবেশ পুলিশ প্রবর্তন জরুরি

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা : নাগরিকের সঙ্গে যেমন রাষ্ট্রের সম্পর্ক অতি নিবিড়, তেমনি পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক রয়েছে। জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বটে। পরিবেশ দূষিত হলে অর্থাৎ পরিবেশের কোনো উপাদানের ব্যত্যয় হলে জনস্বাস্থ্য বিশেষ করে মানুষের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ মানুষের জীবনযাপন করেছে নিয়ন্ত্রণহীন। যার ফলে বায়ু, পানি ও শব্দদূষণের মতো সমস্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বায়ু ও রাসায়নিক দূষণের কারণে পরিবেশের বৈরিতা ক্রনিক অবস্টেট্রিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি’র) ঝুঁকি বাড়ায়। বুড়িগঙ্গা নদীর বিষাক্ত পানির গন্ধে নদীর তীরের বাসিন্দারা যেমনি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তেমনি ইটের ভাটার দূষণ ও শব্দদূষণের কারণে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। বায়ু, পানিসহ বিভিন্ন ধরনের দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জন নিরপরাধ মানুষ অকালে মারা গিয়েছে, এই তথ্য উঠে এসেছে ল্যানসেট ‘কমিশন অন পলিউশন অ্যান্ড হেলথ’ রিপোর্টে। আরও ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন দূষণের কারণে অকাল মৃত্যুতে বিশ্বে ষষ্ঠ অবস্থানে বাংলাদেশ। তাই পরিবেশ সুরক্ষায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। 

প্রতি বছর পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকা অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী অবিবেচক মানুষ। অনেক ক্ষেত্রে আইন করলেও প্রয়োগের অপ্রতুলতার কারণে আইনের সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। সব নিঃসরণ ভালো নহে; যেমন-যন্ত্র ও যন্ত্রদানব ব্যবহারের কারণে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ। আবার সব নিঃসরণ খারাপও নহে, যেমন: বৃক্ষ ও বনভূমি কর্তৃক প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় অক্সিজেন নিঃসরণ। প্রকৃতির শোষণ ও নিঃসরণকে অবহেলা করলে, তা মানুষের জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বনভূমি, উদ্যান, জলাশয় ইত্যাদি ভূপৃষ্ঠ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ প্রাণ-প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর গ্যাস শোষণ করে এবং প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষায় অক্সিজেন নিঃসরণ করে।

পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে সারা পৃথিবীতে যেখানে টেকসই উন্নয়নের পথে ধাবিত ও অগ্রসর হচ্ছে। সেখানে প্রতিনিয়ত বায়ু, পানি ও শব্দদূষণ করা হচ্ছে এবং বৃক্ষ নিধন, নদী ও জলাশয় ভরাট করে ইমারত, অবকাঠামো, কলকারখানা নির্মাণের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলছে। এই পরিস্থিতির একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো বুড়িগঙ্গা, বালি, তুরাগ, শীতলক্ষা মৃত নদীতে রূপ নিয়েছে। ফলে নদী ও তার আশপাশে পরিবেশ হয়েছে বিপন্ন প্রায়। শিল্প এলাকার নিরাপত্তায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, মহাসড়কের নিরাপত্তায় হাইওয়ে পুলিশ রয়েছে, তাহলে পরিবেশ দূষণ রোধ, পরিবেশ সুরক্ষায় ও জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তার জন্য পরিবেশ পুলিশ নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।

যেহেতু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মানুষ, তাই মানুষের সুরক্ষার স্বার্থে এমন কোনো কর্মকাণ্ড না করা বা করতে কাউকে সুযোগ না দেয়া এবং কর্মকাণ্ড হতে বিরত থাকতে বাধ্য করা যাতে জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব না পড়ে। আধুনিক ও উন্নত বিশ্বে সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুলিশের সেবাকে বাংলাদেশের জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বিট পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করেছেন। সেবার কার্যক্রমকে গতিশীল ও কার্যকর করা এবং পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে প্রতিটি থানাকে ইউনিয়নভিত্তিক বা মেট্রোপলিটন এলাকায় ওয়ার্ডভিত্তিক এক বা একাধিক ইউনিটে ভাগ করে পরিচালিত পুলিশিং ব্যবস্থাই বিট পুলিশিং। বর্তমান বাস্তবতায় পরিবেশ সুরক্ষা ও সংরক্ষণ কার্যক্রমে বিট পুলিশকে যুক্ত করা হলে তা পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি লুইস ব্রান্ডাইস এর মতে, A Little sunshine is the best disinfectant”  অনেক সময় একটুখানি রোদই সবচেয়ে মোক্ষম সংক্রামক প্রতিরোধক। যেমনটা ভিটামিন-ডি’র জন্য দরকার বিকালের সূর্যের আলো। পরিবেশ সুরক্ষা ও উন্নয়ন পুলিশ চাই। যারা পরিবেশ দূষণ বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সাধারণ পুলিশ স্টেশনে জেনারেল ডায়েরি বা এজাহার দাখিলের মতো পরিবেশ সুরক্ষা পুলিশও পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং পরিবেশ দূষণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকবে। অভিযোগ দাখিলের ১ ঘণ্টার মধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এছাড়া পলিথিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন, পরিবহন ইত্যাদি বন্ধের জন্য বাজার মনিটরিং করা। সামাজিক অনুষ্ঠানের নামে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নদী, নালা, জলাশয় দূষণ নিয়ন্ত্রণে অভিযোগ পাওয়ার ১ ঘণ্টার মধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণে ওই স্থানে গিয়ে দূষণকারীদের আটক করা এবং বনভূমি, উদ্যান, পার্ক, মাঠসহ গণপরিসরের গাছ এবং বৃক্ষ নিধন ও সাবাড়কারী, দখল ও দূষণকারীকে আইনের আওতায় আনা। পাশাপাশি বায়ুদূষণ বন্ধে ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নেও কাজে করবে পরিবেশ সুরক্ষা পুলিশ (পরিবেশ পুলিশ)।

বিশেষ করে সামাজিক অনুষ্ঠানের নামে রাতের বেলায় লাইন্ড স্পিকার বাজিয়ে শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে ১ ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সাক্ষী সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অভিযোগকারীর নাম ও পরিচয় গোপন রাখার বিষয়টিও নিশ্চিতা দেয়া থাকবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও হাইওয়ে পুলিশ এর ন্যায় পরিবেশ পুলিশ (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অনুচ্ছেদ ১৮(ক) বাস্তবায়নে) পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সব ধরনের দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। লিখিত বা মৌখিক, অথবা ফোনে বা ই-মেইলে অভিযোগ দেয়ার জন্য পুলিশ স্টেশনগুলো আলাদা আলাদা সেল রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

যেহেতু রাষ্ট্র আইন করেছে মহানগরীর, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উম্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ সংরক্ষণ করবে। তাই আইন অনুসারে খেলার মাঠ, উম্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। এখানে শ্রেণি পরিবর্তন বলতে মাটি ভরাট, পাকা, আধাপাকা বা কাঁচা ঘরবাড়ি এবং অন্য যে কোনো ধরনের ভবন নির্মাণের জন্য জমির অবস্থান পরিবর্তন বুঝাইবে। যেহেতু পরিবেশদূষণের কারণে জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভব পড়ছে। কারণ পরিবেশের কোনো উপাদানের ব্যত্যয় হলে জনস্বাস্থ্য বিশেষ করে মানুষের ওপর প্রভাব পড়ে। তাই পরিবেশ সুরক্ষায় রাষ্ট্রকে আরও আন্তরিক হয়ে কার্যকর পদক্ষপে গ্রহণ করতে হবে। 

আইনজীবী 

masumbillahlaw06@gmail.com