মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র

জমি ও জীবিকা হারানো ৫০ পরিবার খাদ্য সংকটে

এস এম রুবেল, কক্সবাজার: রহিমা বেগম চার বছর ধরে পরিবারের আট সদস্য নিয়ে বসবাস করছেন পুনর্বাসনে পাওয়া দুই কক্ষবিশিষ্ট ছোট্ট ঘরে। ঘরের দেয়ালে লিখা আছে, ‘নীড়-৪২, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিঃ।’ পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসার আগে তারা সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতেন। কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প এসে তাদের ঘর, জমি, মাছের প্রজেক্ট, নদীসহ সব কাজ করার মাধ্যম কেড়ে নিয়েছে।
ভবিষ্যতে পরিবার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে রহিমা বেগম বলেন, ‘আমরা খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করছি। চরম কষ্টে আছি। কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের সন্তানদের চাকরি দেয়নি। চাকরির জন্য অফিসারদের পায়ে ধরে কেঁদেছি। এখন ঘর পেয়েছি, কিন্তু পেটে ভাত দিতে পারছি না। এখন আগের মতো কাজ করার সুযোগ নেই। আগে ছিল লবণ পরিবহন ও চাষ, মাটিকাটা, মাছের পোনা আহরণ, মাছ ও কাঁকড়া চাষ। কয়লা বিদ্যুৎ আসার কারণে এসব পেশা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।’

জানা গেছে, ২০১৪ সালে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সময় ৫০ পরিবারকে উচ্ছেদ করে প্রকল্পের ২নং গেটের পাশে পুনর্বাসন করা হয়। তাদের মধ্যে ৪৪ পরিবারকে ঘর দেয়া হলেও ছয় পরিবারকে এখনো ঘর দেয়া হয়নি। সেই ছয়টি ঘর নির্মাণের পর থেকে তালাবদ্ধই রেখেছে কর্তৃপক্ষ। ঘর না পাওয়া মানুষগুলো ঘুরছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়।
সরজমিনে পুনর্বাসন কেন্দ্রে দেখা যায়, অরক্ষিত পুনর্বাসন কেন্দ্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, কবরস্থান, ক্লিনিক, খেলার মাঠ কিছুই নেই। সামনে পড়ে আছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। সেখানেই খেলাধুলা করছে শিশুরা। ছোট দুটি কক্ষবিশিষ্ট প্রতিঘরে বসবাস করছে ৮ থেকে ১০ জন করে মানুষ। যাদের কারও নেই স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সুরক্ষা। বাসিন্দারা জানান, ছোট এই জায়গায় তারা ৪৫০ জন মানুষ বাস করছেন। যাদের মধ্যে শিশু রয়েছে প্রায় ২০০ জন আর কর্মক্ষম বেকার পুরুষ রয়েছেন ১২০ জন মতো। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু ঘর বাড়ানোর জমি ও সামর্থ্য কোনোটিই তাদের নেই। এমনকি ঘরের অভাবে বিয়ে করতে পারছেন না সেখনকার অনেক যুবক।

তারা আরও জানান, ঘর হস্তান্তরের সময় প্রত্যেক পরিবারের একজন সদস্যকে স্থায়ী চাকরি এবং তিন বছরের মধ্যে প্রত্যেক ঘরের মালিকদের নামে জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তারা। কিন্তু ১০ বছর অতিবাহিত হলেও জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়নি এবং কয়েক বছরের মধ্যে চাকরি চলে যায় সব মানুষের। স্থায়ী বাসযোগ্য জমি ও চাকরি না পাওয়ায় যেখানে আছেন সেখান থেকেও উচ্ছেদের ভয় কাজ করছেন তারা। তারা জানেন না তাদের ভবিষ্যতে কি হবে। বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী শাকিল ও মুহাম্মদ জাকারিয়া জানিয়েছেন, প্রকল্পের কারণে পেশা হারিয়েছেন তারা। কাজের ক্ষেত্রও নেই। এখন অনাহারে জীবনযাপন করছেন। তাদের কর্মের ব্যবস্থা না হলে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়বে। মহেশখালী জনসুরক্ষা মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘কয়লা বিদ্যুতের কারণে পরিবারগুলোর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। টেকসই ঘর দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে দেয়া হয়েছে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি ছোট ঘর। মানুষগুলো চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের টেকসই পুনর্বাসন করা না হলে আন্দোলন করা হবে।’
মাতারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু হায়দার জানান, প্রকল্পের কারণে
পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের স্থায়ী চাকরি না দিয়ে কোম্পানিতে অস্থায়ী চাকরি দেয়া হয়েছিল। কোম্পানি চলে গেলে তারা চাকরি হারান।

ওইসব পরিবারের সদস্যদের কোল পাওয়ারে এখনও চাকরি দেয়ার সুযোগ আছে জানিয়ে চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘সিন্ডিকেটের কারণে বাইরের মানুষ চাকরি পেলেও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা বেকার। প্রকল্পে পিয়ন, সিকিউরিটি, অফিস সহকারী, কয়লা আনলোড ও পরিষ্কারসহ নানা কাছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকদের চাকরি দেয়ার জোর দাবি জানান তিনি। এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন জানান, তিনি বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানেন না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর খোঁজ নিয়ে কোল পাওয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. নাজমুল হক জানান, ক্ষতিগ্রস্ত ৪৪ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাদের জমির দলিল হস্তান্তরের বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে তাদের প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন করে চাকরি নিশ্চিতের বিষয়টি চুক্তিতে উল্লেখ আছে কিনা দেখতে হবে। এরপর বিস্তারিত জানাতে পারবেন বলে জানান তিনি।