মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য সম্প্রতি লেনদেন বন্ধ করা হয়েছে রহিমা ফুডের। দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন নেই এ প্রতিষ্ঠানটির। এর মধ্যে হঠাৎ করেই মুনাফায় ফিরেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টিকে অস্বাভাবিক মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জমি বিক্রির টাকা মুনাফায় যোগ হয়েছে; যে কারণে ঘুরে দাঁড়িয়েছে কোম্পানিটি।
জানা যায়, রহিমা ফুডের মোট জমি ছিল ২৩৩ দশমিক ৫০ ডেসিম্যাল। এর মধ্যে ১৩১ দশমিক ৫০ ডেসিম্যাল বিক্রি করে দিয়েছে। কোম্পানিটি এটি কিনেছিল এক কোটি পাঁচ লাখ টাকায়, যা বিক্রি করা হয়েছে ২০ কোটি টাকায়। এক্ষেত্রে কোম্পানিটির ক্যাপিটাল গেইন হয়েছে ১৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এ অর্থই মুনাফায় যোগ হয়েছে।
সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রহিমা ফুড ২০১৮-১৯ হিসাববছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ তিন মাসে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১২ পয়সা। এর আগের বছর একই সময় শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ১৪ পয়সা। একই সময় প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) হয়েছে ১১ টাকা ৯২ পয়সা।
এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির সচিব জাকির হোসাইন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গত বছর আমরা জমি বিক্রি করেছিলাম, সেই অর্থ মুনাফায় যোগ করা হয়েছে। এটি ক্যাপিটাল গেইন হিসেবে দেখানো হয়েছে। যে কারণে মুনাফা বেড়েছে।’ খুব শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনে আসছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা নিয়ে কর্তৃপক্ষ কাজ করছে; তবে কবে নাগাদ লেনদেনে ফেরার অনুমতি পাবে সে বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।
এদিকে সম্পদ বিক্রির টাকা ক্যাপিটাল গেইনে যোগ হতে বাধা না থাকলেও এটা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, সাধারণত কোনো কোম্পানির আর্থিক অবস্থা দুর্বল হলেই সম্পদ বিক্রি করে। এটা দীর্ঘমেয়াদি ভালো লক্ষণ নয়।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসই’র একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রহিমা ফুড কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। অন্যদিকে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি তালিকাচ্যুত রয়েছে। এ অবস্থায় সম্পদ বিক্রি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্যই ভালো লক্ষণ নয়।
একই বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, জমি বিক্রির অর্থ ক্যাপিটাল গেইনে যোগ হয়। এটি যোগ হয় শেয়ারপ্রতি আয়ে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এই অর্থ ভাগ হয়ে যায়। তাই কোনো কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রির অর্থ ক্যাপিটাল গেইনে যোগ হতে বাধা নেই।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, তালিকাচ্যুত প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১৫ কোটি টাকার বেশি। প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে পড়ে ২০১৪ সাল থেকে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি ঋণের দায়ে জর্জরিত।
১৯৯৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ২৫ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ২০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারসংখ্যা দুই কোটি।
দীর্ঘদিন উৎপাদনে না থাকা এবং শেয়ার নিয়ে কারসাজি হওয়ার কারণে কিছুদিন আগে দুই কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত (ডি-লিস্টেড) করেছে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। কোম্পানি দুটি হলো রহিমা ফুড করপোরেশন ও মডার্ন ডায়িং। ডিএসই দাবি করছে, এতে বিনিয়োগকারী ও বাজারের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে। তবে সেসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন লাখো বিনিয়োগকারী। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা অর্থ আদৌ ফিরে পাবেন কি-না, এ নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন তারা।
যদিও ডিএসই বলছে, দীর্ঘদিন উৎপাদনহীন এসব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে প্রায়ই কারসাজি হয়ে থাকে, এতে বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে। আর এ কারণে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কোম্পানিগুলোকে তালিকাচ্যুত করা হয়েছে। তবে বিনিয়োগকারীরা বলছেন ভিন্ন কথা।
তাদের মতে, কোম্পানি দুটির উৎপাদন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকলেও তার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও ডিএসই। কোম্পানি দুটির মধ্যে রহিমা ফুডের উৎপাদন প্রায় দেড় যুগ ধরে বন্ধ রয়েছে। আর মডার্ন ডায়িংয়ের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে প্রায় আট বছর যাবৎ। অথচ আইন অনুযায়ী কোনো কোম্পানি তিন বছর বা তার বেশি সময় উৎপাদন বন্ধ রাখলে স্টক এক্সচেঞ্জ সে কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করতে পারে। কিন্তু ডিএসই তা করেনি। আর এ সময়ের মধ্যে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে নানাভাবে শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে একটি চক্র বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তালিকাচ্যুতির আগে দুবছরে রহিমা ফুডের শেয়ারদর ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮৪ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।