জলবায়ু উচ্চাকাক্সক্ষাকে বাধা দিচ্ছে দক্ষিণ গ্লোবাল সাউথের ঋণ সংকট

দুবাইয়ে শুরু হয়েছে এ বছরের জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ২৮)। এ ব্যাপারে গভীর হতাশাবাদী থেকে শুরু করে সতর্কভাবে আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। এটা আসলে নির্ভর করে আপনি কাকে জিজ্ঞাসা করছেন। তবে কার্যকর জলবায়ু পদক্ষেপ যে আগের চেয়েও জরুরি এ ব্যাপারে সবাই একমত।

কপ২৮-এর এই সমবেত প্রয়োজনীয়তা বোধ খুব গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের সব পক্ষের প্রতিনিধি, অন্যান্য স্টেকহোল্ডার ও ব্যবসায়ী নেতা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানীসহ প্রায় ৭০ হাজার প্রতিনিধি এতে অংশ নেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। এ ধরনের বিশাল ও বৈচিত্র্যময় জমায়েত বেখাপ্পা লাগতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়ে যাওয়া এই বিস্তৃত যোগাযোগ অগ্রগতির জন্য সহায়ক। এ ধরনের জটিল ও বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সরকার, অর্থনীতি ও সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বৈশ্বিক পদক্ষেপ প্রয়োজন এবং সেজন্য সময় যে ফুরিয়ে আসছে-এমন ক্রমবর্ধমান সচেতনতা এ পদক্ষেপ ত্বরান্বিত করতে পারে।

যদিও বিস্তৃতিভিত্তিক পদক্ষেপ জটিল। তবে বাস্তবতা হলো, শুধু কয়েকটি মূল সংগঠনের হাতে বৈশ্বিক নির্গমনে আমূল হ্রাস আনার ক্ষমতা রয়েছে। সব গ্রিনহাউস-গ্যাস নির্গমনের ৬০ শতাংশেরও বেশি সৃষ্টি হয় মাত্র ছয়টি অর্থনীতিতেÑচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও ব্রাজিল (মোট নির্গমনের ক্রম অনুসারে)। শুধু নিজস্ব নির্গমন কমানোর জন্য নয়, বরং বিশ্বব্যাপী শক্তির পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় নবায়নযোগ্য এবং অন্যান্য প্রযুক্তির বিকাশ ও বিস্তারকে এগিয়ে নিতেও তাদের অবশ্যই নেতৃত্ব দিতে হবে।

এক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জনের দিকে আলোকপাত করা যায়। উচ্চ আয়ের অর্থনীতিগুলো এরই মধ্যে সর্বোচ্চ নির্গমন তালিকায় স্থান নিয়েছে। কিন্তু নেট-শূন্য লক্ষ্যে পৌঁছাতে এখনও তাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। তাছাড়া এ ব্যাপারে প্রায়ই রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব দেখা যায়। তবে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত রূপান্তরে বিনিয়োগ করার জন্য যথেষ্ট সম্পদ তাদের রয়েছে।

চীন তার জায়গা থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ নির্গমনে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাছাড়া এটি সোলার প্যানেল, বৈদ্যুতিক যান, ব্যাটারিসহ প্রাসঙ্গিক প্রযুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠেছে। যদি এটি তার বিকাশকে অব্যাহত রেখে ডিকার্বনাইজ করতে পারে, তবে এটি বাকি উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি শক্তিশালী নজির স্থাপন করবে।

এবার আসি ভারতের প্রসঙ্গে। দেশটির প্রচুর পরিমাণে প্রবৃদ্ধি এখনও ভবিষ্যতে অপেক্ষায় রয়েছে। এর সর্বোচ্চ নির্গমন শিখরটি সম্ভবত আরও দূরে। প্রকৃতপক্ষে কিছু প্রযুক্তিগত অলৌকিক ঘটনা বাদ দিলে ভারতের নির্গমন সম্ভবত আরও ১০-১৫ বছর বাড়তে থাকবে। তা সত্ত্বেও তারা আপাতত তুলনামূলকভাবে কম নির্গমন করছে, মাথাপিছু বার্ষিক দুই টনেরও কম। এটি এমন একটি স্তর যেজন্য উন্নত অর্থনীতিগুলো কেবল চেষ্টাই করে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বার্ষিক নির্গমন ২০২০ সালে মাথাপিছু ১৩ টন ছিল। বিশ্বের বড় দূষণকারী অর্থনীতির উচিত সিওপি২৮-কে তাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট দ্রুত কমানোর জন্য একটি সমন্বিত নীতি তৈরির সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করা।

আরেকটি আশাব্যঞ্জক উন্নয়ন হলো, কৃষি শেষ পর্যন্ত তার প্রাপ্য মনোযোগ পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। মারাকেশে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক বার্ষিক সভায় বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বঙ্গ এই ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন তুলে ধরেন। ঐতিহ্যগতভাবে ধানের ক্ষেত উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্লাবিত হয়। ক্ষেতে বীজ বপন থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত তা নিমজ্জিত থাকে। কিন্তু এতে ব্যাপক পরিমাণ মিথেন গ্যাস নির্গমনের হয়। তাছাড়া চাষের জন্য এটি প্রয়োজনীয়ও নয়। রোপণের পরে জল নিষ্কাশন করে এবং তারপর ফসল কাটা পর্যন্ত ক্ষেতে প্রয়োজনমতো জল দেয়ার মাধ্যমে মিথেন নির্গমন ৬০ শতাংশ কমে যায়। এই ধরনের জলবায়ুবান্ধব (ক্লাইমেট স্মার্ট) কৃষি সমাধানের দিকে উত্তরণের জন্য কপ২৮ এজেন্ডায় সমর্থন বাড়ানো উচিত।

তবুও আশার কথা হলো, স্বেচ্ছা ও বাধ্যতামূলক উভয় কারণেই কার্বন মোকাবিলার দাবি আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করা হয়, তাহলে একটি কার্বন-অফসেট মার্কেটপ্লেস জলবায়ু-পরিবর্তন প্রশমনের জন্য অর্থায়নকে শক্তিশালী। এ ধরনের বিনিয়োগ সবচেয়ে সাশ্রয়ী হবে বিশেষ করে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে, অর্থাৎ এমন জায়গাগুলোতে যাদের প্রশমনের জন্য নিজেদের অর্থের অভাব রয়েছে।

কার্যকর কার্বন-অফসেট বাজারের বিকাশের জন্য কমপক্ষে দুটি মূল চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে। প্রথমত, একটি নির্ভরযোগ্য সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা অপরিহার্য। এতে নিশ্চিত করা হবে যে, কার্বন-অফসেট পারচেজ এমন প্রকল্পে অর্থায়ন করবে, যা প্রকৃতপক্ষে বৈশ্বিক নির্গমন কম করে বা বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ হ্রাস করে। এটা শুনে যা মনে হচ্ছে তার চেয়েও কঠিন। অনেক নেতা প্রভাবের চেয়ে জনপ্রিয়তা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন এবং তারা এ নিয়ে ফায়দা নেয়ার সুযোগ খুঁজবে। একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুসারে, শীর্ষ ৫০টি নির্গমন-অফসেট প্রকল্পের মধ্যে ৩৯টি সম্ভবত এক বা একাধিক মৌলিক ব্যর্থতার কারণে অকেজো হয়ে আছে, যা এর প্রতিশ্রুত নির্গমন হ্রাসকে দুর্বল করে।

কার্বন-অফসেট বাজারের কার্যকারিতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে কপ২৮ অবশ্যই যোগ্যতার মানের একটি সেট তৈরি করবে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের ক্লিন ডেভেলপমেন্ট মেকানিজম থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত, যা বহু বছর ধরে, উন্নয়নশীল দেশের প্রকল্পগুলোর জন্য সার্টিফিকেশন পদ্ধতি পরিমার্জিত করেছে। বেশ কিছু স্বাধীন তৃতীয় পক্ষের প্রতিষ্ঠান অফসেট অর্থায়নের জন্য উপযুক্ত বিনিয়োগকেও প্রত্যয়িত করে, যদিও এটি এখনও প্রক্রিয়াধীন। মোটকথা, নিরীক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু মান নির্ধারণ কেবল শুরু। বিশ্বব্যাপী নেট-জিরো নির্গমনে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অর্থায়ন করার জন্য সরকারের আর্থিক ক্ষমতা নেই। সুতরাং প্রচুর পরিমাণে ব্যক্তিগত এবং সার্বভৌম পুঁজি বিনিয়োগ করার প্রয়োজন রয়েছে। (এটিকে কার্বন-অফসেট বাজারের সরবরাহ দিক হিসাবে দেখা যায়।)

এ লক্ষ্যে, আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, জলবায়ু-প্রশমন প্রকল্পগুলোয় বিনিয়োগের ঝুঁকি-সমন্বিত আয় বিকল্প বিনিয়োগের অপশনগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক। সমস্যা হলো যে, অনেক উন্নয়নশীল দেশে অঞ্চলভিত্তিক ঝুঁকি জলবায়ু অভিঘাতসহ বাহ্যিক ধাক্কাগুলোর দুর্বলতা পুঁজির খরচ বাড়িয়ে দেয়। সেজন্য বিশ্বব্যাংকের মতো বহুপক্ষীয় উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই জ্ঞানী সহ-বিনিয়োগকারী হিসেবে কাজ করতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ঝুঁকি ভাগাভাগি করে নিতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন বৃদ্ধি এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরিচালনা করার জন্য দেশগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।

কপ২৮-এর জন্য একটি চূড়ান্ত অগ্রাধিকার হলো, জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয়ের প্রভাবগুলির জন্য দুর্বল দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি সম্মত হওয়া ক্ষয়ক্ষতির তহবিলকে কার্যকর করা। কপ২৮ এক্ষেত্রে ও পূর্বোক্ত সব ক্ষেত্রেই অগ্রগতি এনে দিতে পারেÑএমন বিশ্বাস করার উপযুক্ত কারণ রয়েছে। আসল পরীক্ষা তখন আসবে, যখন নেতাদের তাদের প্রতিশ্রুতি মেনে চলতে হবে।

মারিয়া ফারনান্দা এসপিনোসা, নির্বাহী পরিচালক, গ্লোবাল উইমেন লিডার
ঋষিকেশ রাম ভাণ্ডারি, সহকারী পরিচালক, গ্লোবাল ইকোনমিক গভার্ন্যান্স ইনিশিয়াটিভ,
বোস্টন ইউনিভার্সিটি

প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে ভাষান্তর
শামসুন নাহার