Print Date & Time : 5 July 2025 Saturday 10:49 pm

জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলে গবাদিপশু পালনে সমস্যা

রিয়াদ হোসেন : প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। দিন দিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে এসব জনপদ। বছরের পর বছর প্রকৃতির বিরূপ আচারণের সঙ্গে মানুষ খাপখাওয়াতে না পেরে ভিটামাটি ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছে। এতে তৈরি হচ্ছে খাদ্য, বাসস্থানসহ জীবনযাত্রায় নানা সংকট। এদিকে উপকূলীয় অঞ্চলকে মাতৃস্নেহে আগলে রাখা সুন্দরবনও ধ্বংসের দারপ্রান্তে। প্রতিবছর আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে যে সুন্দরবনের প্রভাবে এসব জনপদে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়; সেই সুন্দরবনও আজ ভালো নেই। বিষ দিয়ে মাছ শিকার, অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারীদের নির্বিচারে গাছ নিধন এবং চোরা শিকারিদের হাতে মরছে বাঘ-হরিণসহ সুন্দরবনের নানা প্রজাতির প্রাণী। এভাবে সুন্দরবন ধ্বংস হতে হতে উপকূলীয় জনপদও একটি সময় বিলীন হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা বহু আগে থেকে করা হচ্ছে। এরপরও সুন্দরবন বাঁচাতে কিংবা উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষা করতে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে না। আর প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় বা বৃষ্টি মৌসুমে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে সেগুলোও কোনো কাজে আসছে না। মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে ভিটেমাটি ছেড়ে শহরে গিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে। শহরের জীবনযাত্রায়ও যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে একদিকে যেমন কৃষি উৎপাদন কমে গেছে তেমনি গবাদিপশুর উৎপাদনও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় গবাদিপশুর উৎপাদন আগের তুলনায় অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে এসব অঞ্চলে মিষ্টি থেকে শুরু করে দুগ্ধজাত পণ্যের দামও বেড়ে চলেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দিন দিন কৃষি জমির পরিমাণ কমে আসছে। মানুষ বাধ্য হয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে পেশার পরিবর্তন করছে। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা এবং দাকোপ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর এবং আশাশুনি, বাগেরহাটের শরণখোলায় বর্তমানে গবাদিপশুর উৎপাদন কমে গেছে। কারণ এসব অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, গবাদিপশুর খাদ্য ঘাসসহ অন্য কোনো গো-খাদ্যও উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তারা গবাদিপশুর উৎপাদন থেকে পিছিয়ে আসছে। এমনকি উপকূলীয় এসব অঞ্চলে আসন্ন কোরবানির ঈদে গরু বা ছাগল কোরবানির জন্য অন্যান্য জেলা থেকে পশু আনা হবে। কারণ যে পশু এখানে উৎপাদন করা হয়েছে সেগুলো দিয়ে চাহিদা মেটানো হয়ে উঠবে না। তাছাড়া বছরে বছরে যখন এসব জনপদে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় হানা দেয় তখন নিজেদের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে গবাদিপশুর জীবন আর বাঁচানো হয়ে ওঠে না। চোখের সামনে অনেক পরিবারের শেষ সম্বলটুকুও পানির স্রোতে ভেসে যায়। উপায়হীন হয়ে তাদের শুধু তা দেখতে হয়। কারণ দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বাঁচার জন্য সাইক্লোন সেল্টার তৈরি করা থাকলেও দুর্যোগকালীন গৃহপালিত পশুপাখির জীবন বাঁচাতে এসব অঞ্চলে এখনও তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এজন্য এসব অঞ্চলে গবাদিপশুর পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতায় গ্রীষ্মের সময় প্রচণ্ড গরম পড়ছে, শীতের সময় অধিক পরিমাণে শীত এবং বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির ফলে দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে উপকূলীয় জনপদে। মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়ে এলাকা ছাড়ছে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে এমন একটি সময় আসবে যখন দেশের মানচিত্র থেকে উপকূলীয় এসব অঞ্চল হারিয়ে যাবেÑ তা আর বেশি দেরি নেই। তাই এসব অঞ্চলকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের আরও আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছা প্রয়োজন। আমরা দেখেছি, প্রতি বছর যখন বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙন দেখা দেয় তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের টনক নড়ে। তারা তখন বেড়িবাঁধ দেয়ার জন্য তোরজোর শুরু করে দেয়। কিন্তু সে বাঁধ বছর না যেতেই নদীর সঙ্গে মিশে যায়। এতে একদিকে যেমন প্রতিবছর সরকারের অর্থের অপচয় ঘটছে, অন্যদিকে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে। তাই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি এসব অঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে লবণ সহনশীল ফসল উৎপাদনে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে এসব জনপদে যাতে গবাদিপশুর উৎপাদন কমে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে গো-খাদ্য উৎপাদনে সরকারের সহযোগিতা বাড়াতে হবে। খামারি বা স্থানীয়দের গবাদিপশুর উৎপাদন বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করতে হবে। গবাদিপশুর চিকিৎসায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাসহ সরকারিভাবে আরও নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যাতে সহজে কোনো পশু রোগে আক্রান্ত হলে তারা চিকিৎসা নিতে পারে। প্রয়োজনে গবাদিপশুর উৎপাদন বাড়াতে সরকারের ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। আশা রাখি, উপকূলীয় জনপদে গবাদিপশুর উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যথাযথ উদ্যোগ নেবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা।