জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে বায়োচার প্রযুক্তি

. শামীম মিয়া: মনুষ্যসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস, যেমন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি নিঃসরণের ফলে পৃথিবীবেষ্টনকারী বায়ুমণ্ডলের গ্যাসের আপেক্ষিক ঘনত্ব ও পরিমাণ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। উল্লিখিত গ্যাসগুলো তাপ ধরে রাখার কারণে পৃথিবীতে আপতিত সূর্যরশ্মি যে তাপ উৎপাদন করে, তা পৃথিবীর বাইরে যেতে পারে না। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা দিন দিন বেড়ে চলছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নামে পরিচিত। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন সাইক্লোন, খরা, লবণাক্ততা প্রভৃতির পরিমাণ ও তীব্রতা বাড়ছে। ফসল উৎপাদন যেহেতু সরাসরি জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল, তাই জলবায়ুর এই পরিবর্তন ফসল উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্ষতিকর দিক মোকাবিলা করতে হলে গ্রিনহাউস গ্যাসের উদ্গিরণ কমানোর পাশাপাশি বায়ুমণ্ডলে থাকা অতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণও কমিয়ে আনতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক মোকাবিলা করার জন্য বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এবং নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। যেসব প্রযুক্তি গ্রিনহাউস গ্যাস কমাতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো (ক) নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, (খ) গ্রিনহাউস গ্যাস কম উৎপাদন করে এমন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং (গ) বনায়ন। এসব প্রযুক্তির মধ্যে বনায়নকে সবচেয়ে সহজ এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট সময় পর গাছ বায়ুমণ্ডল থেকে যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে, তার সমপরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ শুধু গাছ লাগিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধ করা সম্ভব নয়। উল্লিখিত গবেষণায় বিকল্প একটি প্রস্তাব করা হয়, যা হলো বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে প্রথমে বনায়নের মাধ্যমে গাছের মধ্যে নিয়ে আসা এবং পরে সেই কার্বনকে পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করে মাটিতে প্রয়োগ করা। পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত এই কার্বনকে বলা হয় বায়োচার।

বায়োচার হলো বিভিন্ন জৈব পদার্থ, যেমন কাঠ, কাঠের গুঁড়া, জৈব আবর্জনা ইত্যাদিকে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদিত এক ধরনের কয়লা। অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে তাপ প্রয়োগের ফলে জৈব পদার্থগুলোর সরল জৈব যৌগগুলো অ্যারোমেটিক বেনজিনযুক্ত জৈব যৌগে পরিণত হয়। যেহেতু মাটির অণুজীবগুলো অ্যারোমেটিক বেনজিনযুক্ত জৈব যৌগগুলোকে সহজে ভাঙতে পারে না, তাই বায়োচার মাটিতে প্রয়োগ করলে এটি দীর্ঘসময় (১০০ বছর বা তার অধিক) পর্যন্ত মাটিতে থেকে যায়, যা সাধারণত কার্বন স্থায়ীকরণ নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলের কার্বনকে দীর্ঘ সময়ের জন্য মাটিতে স্থায়ীকরণ করে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তন রোধের জন্য যতগুলো প্রযুক্তি আছে, সম্ভবত এটি সবচেয়ে সহজ ও টেকসই প্রযুক্তি। ২০১৮ সালের আগস্টে আইপিসিসি (ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) এই প্রযুক্তিকে জলবায়ু পরিবর্তনরোধী প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে এই প্রযুক্তি নিয়ে সারা পৃথিবীতে ব্যাপক গবেষণা চলছে। যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োচার গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি স্বতন্ত্র গবেষণাগার স্থাপন করা হয়েছে। বায়োচার প্রযুক্তির সম্ভাবনাময় দিকগুলো হলোÑ(ক) বায়োচার তৈরির সময় যে তাপশক্তি উৎপাদিত হয় তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, (খ) আবর্জনা থেকে বায়োচার উৎপাদন করলে আবর্জনার ব্যবস্থাপনা সহজতর হয়, (গ) উৎপাদিত বায়োচার ব্যবহার করে দূষণ রোধ করা যায় এবং (ঘ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বায়োচার ব্যবহারে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ এবং উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি বায়োচার ব্যবহারে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর উৎপাদনও কম হয়।

বায়োচারের সম্ভাবনাময়ী দিকগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই প্রযুক্তি বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় একটি প্রযুক্তি হতে পারে। বাংলাদশে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের কতগুলো উল্লেখযোগ্য দিক হলো

(ক) শহরের জৈব বর্জ্য থেকে বায়োচারসমৃদ্ধ কম্পোস্ট উৎপাদন: শহরের আবর্জনা ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি বড় সমস্যা, কারণ আমাদের শহরের নাগরিকদের মধ্যে জৈব ব্যবস্থাপনার নীতি মানার প্রবণতা অনেক কম। আমাদের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের শহরের জৈব বর্জ্য থেকে প্রতি বছর ২৬, ২৩ ও ২৮ হাজার মেট্রিক টন সমতুল্য ইউরিয়া, টিএসপি এবং এমওপি কৃষিজমিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ব্রয়লার মুরগির বিষ্ঠা থেকেও বায়োচার তৈরি করা যায়। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে যেমন শহর ও পোলট্রি শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহজতর হবে, অন্যদিকে বর্জ্য থেকে উন্নতমানের জৈব সার উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

(খ) বায়োচারসমৃদ্ধ সার উৎপাদন: বায়োচার ব্যবহারের মাধ্যমে রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। যদিও এই সম্পর্কে গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায় আছে, তবুও ধারণা করা হচ্ছে, বায়োচারসমৃদ্ধ রাসায়নিক সার উৎপাদন ও ব্যবহারের মাধ্যমে সারের ব্যবহার দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর সারের জন্য ভর্তুকি হিসেবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। যদি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারের ব্যবহার দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়, তবে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় করা সম্ভব।

(গ) বায়োচার থেকে সক্রিয় কার্বন তৈরি: বায়োচার থেকে সক্রিয় কার্বন তৈরি করা যায়। সক্রিয় কার্বন বিভিন্ন রকম দূষণ দূরীকরণে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া মাটি থেকে লবণাক্ততা ও আর্সেনিকসহ অন্যান্য ভারী ধাতু দূরীকরণে বায়োচার একটি কার্যকর প্রযুক্তি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

বর্তমানে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বায়োচার নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চলছে। তবে এ প্রযুক্তি সফলভাবে ব্যবহারের জন্য আরও অধিকতর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

বায়োচার গবেষক ও অধ্যাপক

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে

smia-agr@pstu.ac.bd