Print Date & Time : 5 September 2025 Friday 1:28 am

জলাভূমি রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা : পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষায় সবচেয়ে সমৃদ্ধ উদাহরণ হলো জলাভূমি। খাদ্য নিরাপত্তাতেও জলাভূমির ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্বাস্থ্যকর জলাভূমি অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের পানি শোষণ করে এবং শুষ্ক মৌসুমের জন্য পানি সংরক্ষণ করে। এছাড়া অনাবৃষ্টি ও তাপদাহের মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলোর নেতিবাচক প্রভাব হ্রাসে জলাভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জলাভূমি আমাদের জীবন-জীবিকায় ও অর্থনেতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে। স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি’স)-এর ১, ২, ৫, ৬, ৮, ১১, ১৩, ১৪ ও ১৫নং লক্ষ্যের প্রায় সবগুলোই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পানিসম্পদ সংরক্ষণের প্রতি আলোকপাত করে। ক্ষুধা নিবারণ, দারিদ্র্য-বিমোচন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুপেয় পানির সরবরাহ ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম নিয়ামক হলো পানিসম্পদের সংরক্ষণ ও পরিকল্পিত ব্যবহার; যা জলাভূমির মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব। জলাভূমি জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বন্যানিয়ন্ত্রণ, ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠে পানি সংরক্ষণ, ভূমিক্ষয়রোধ, দূষণরোধ, জলবায়ু বিপর্যয়রোধসহ বহুমাত্রিক সুবিধা প্রদান করে থাকে। এজন্য জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলা ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশের জলাভূমি রক্ষা করা জরুরি।        

সর্বোপরি স্বীকৃত: পরিবেশ, কৃষি, শিল্প, খাদ্য, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, নগরায়ণ ও নারীর ক্ষমতায়নে জলাভূমি অপরিহার্য। তারপরও বর্তমানে বাংলাদেশে অধিকাংশ জলাভূমিই সুরক্ষিত নয়। প্রাকৃতিক জলাভূমির ওপর অত্যাচার, তথা বাঁধ নির্মাণ, ভরাট ও গতিপথ পরিবর্তন অব্যাহত থাকায় পানিচক্রের ভারসাম্য ও ন্যায্যতা নষ্ট হচ্ছে। এজন্য জলাভূমি ও জলাভূমির জীববৈচিত্র্য এবং জীবনযাত্রা হুমকিতে পড়ছে। তাই জলাভূমির ক্রমাবনতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া এবং জলাভূমিতে উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রতিবেশ ব্যবস্থা সঠিকভাবে সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও উদ্যোগ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই বিশ্বব্যাপী জলাভূমি দিবস পালিত হয়।

সারা বছর বা বছরের একটা বড় সময় অথবা মৌসুমে পানিতে ডুবে থাকে বা ভেজা থাকে বলে অনেকেই অহেলা করে জলাভূমি অপ্রয়োজনীয় অঞ্চল বলে মনে করেন। জলাভূমিকে এখনও ‘পতিত’ নিচু অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নিচু মানেই পতিত বা অকাজের জমি নয়। প্রকৃতপক্ষে জলাভূমি মানে ‘জলাভূমি আশ্রিত জীবনপ্রবাহ’। মানবদেহের কিডনির মতো জলাভূমি দেশের কিডনি হিসেবে কাজ করে। তাই জলাভূমিকে দেশের কিডনি বলে অভিহিত করা হয়। এই কিডনি বিকল হলে প্রাণ-প্রকৃতি বিপাকে পড়বে এবং মানুষের বেঁচে থাকাও কঠিন হবে। বর্তমান সময়ে প্রচণ্ড তাপদাহ মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির জীবন হাঁসফাঁস করছে। প্রকৃতির কিডনি হচ্ছে জলাভূমি। কিডনি ছাড়া যেমন জীবন থেমে যায়, তেমনি জলাভূমি ছাড়া প্রকৃতি আর বাসযোগ্য থাকবে না। শহরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমাতেও এটি অগ্রণী ভূমিকা রাখে। তাই জলাভূমির কাছে আমাদের ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না।

বাংলাদেশে উপকূলীয় জলাভূমির চেয়ে বেশি নষ্ট হচ্ছে অভ্যন্তরীণ জলাশয়। বিশেষ করে ঢাকা শহরের জলাভূমির বেশিরভাগই এখন ভরাট করা হয়েছে। যদিও ঢাকা শহরের জন্য ১৯৫৯ সালে প্রস্তুতকৃত প্রথম মহাপরিকল্পনা ছিল মূলত একটি স্থির রূপকল্পভিত্তিক বাসযোগ্য নগর পরিকল্পনা। নগর পরিকল্পনার ধরন পরিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে কৌশলগত পরিকল্পনার দিকে এগোতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ঢাকার জন্য তিন স্তরবিশিষ্ট পরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। যার শিরোনাম দেয়া হয় ‘ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা’। এসব পরিকল্পনায় জলাভূমি (পুকুর, ডোবা, লেক ইত্যাদি) সুরক্ষার কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে যথাযথ কতৃপক্ষের উদাসিনতার কারণে জলাধারগুলো বিভিন্নভাবে সাবাড় হয়ে যাচ্ছে।

জলাভূমি সাবাড়ের ফলে দৈব ও বিভিন্ন কারণে অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনার পর আগুন নিবানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না। অতিসম্প্রতি রাজধানী ঢাকার বঙ্গবাজারে আগুন যথাসময়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় কাছাকাছি জলাধার ও পানির সুব্যবস্থা না থাকা। বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩; পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০১০; জলাধার সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার এবং ভরাট নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০৩; প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ ও ঢাকা মহানগরের জন্য ২০১০ সালে প্রথম বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ), ২০২২-২০৩৫ জলাভূমি সুরক্ষার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা যথাযথভাবে পরিপালন হচ্ছে না। ফলে অবৈধভাবে জলাভূমি ভরাটের অপকর্ম সর্বদাই চলমান। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, দেশের অন্য বড় শহরগুলোর অবস্থাও সংকটাপূর্ণ। পরিবেশদূষণ, অপরিশোধিত ও পয়ঃবর্জ্য ফেলাসহ নানা কারণে এ দেশের জলাভূমিগুলোর প্রায় প্রতিটিই কমবেশি বিপদের সম্মুখীন। বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ নানা জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী হারিয়ে গেছে। বহু জীব বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে এবং অনেক প্রাণীর আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে গেছে। জলাভূমি কমে যাওয়ায় ভূগর্ভে পানির স্তর ক্রমেই নিচে চলে যাচ্ছে। যে কারণে সবার দৈনন্দিন পানির চাহিদা মেটানোর জন্য সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারপরও এর সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানি অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে মাটির তাপ বাড়ার কারণে শহরের আবহাওয়াও অসহনীয় গরম হয়ে উঠেছে। যার নেতিবাচক প্রভাবে বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে রাজধানী ঢাকা। যদিও জলাভূমি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে শহরের অসহনীয় তাপমাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে তা সম্ভব হয়নি।

পৃথিবীর প্রায় ৯০ শতাংশ জলাভূমির ১৭০০ শতক থেকে হুমকির মুখে পড়ছে এবং বনভূমির চেয়ে তিনগুণ হারে জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে জলাভূমি ধ্বংসের কারণে জলবায়ু বিপর্যয় আরও জটিল হয়ে উঠেছে। এই দ্রুত হারিয়ে যাওয়া থেকে জলাভূমি রক্ষা এবং সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে উৎসাহিত করার জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরিও বটে। জলাভূমির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের বিশ্বের জলাভূমির আয়তন হ্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং জলাভূমির বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রথম কনভেনশন হয় ইরানের রামসার শহরে। পরিবেশবাদী এই সম্মেলনে জলাভূমির টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি রামসার কনভেনশন চুক্তি বলে পরিচিত। সেখানে গৃহীত স্মারকে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেছিল। দিনটি স্মরণে রাখতে জাতিসংঘের আয়োজনে ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতি বছর ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হচ্ছে। সেই থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং অনেক বেসরকারি সংস্থা ও কমিউনিটি বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালন করে আসছে।

 আয়তনে ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশে রয়েছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য। বাংলাদেশের প্রাণ এই জলাভূমি তথা পুকুর, ডোবা, জলাশয়, নদী, নালা, হাওরের পরিবেশ, কৃষি, মৎস্য ও পর্যটনের জন্য টেকসই জলাভূমি ব্যবস্থাপনার এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। সাংবিধানিকভাবেও এর গুরুত্ব স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদ এ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন। এ ছাড়াও মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উম্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণের জন্য বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার ২০০০ সালে আইন প্রণয়ন করেন; যা সরকারের পরিবেশবান্ধব নীতির প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাছাড়াও ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর প্রাকৃতিক জলাধার বলে হাইকোর্ট বিভাগ এক রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই রায়ে মহানগর ও বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকায় অবস্থিত ব্যক্তিমালিকানাধীন হিসেবে রেকর্ডভুক্ত পুকুরগুলো ২০০০ সালের জলাধার সংরক্ষণ আইনের ২ (চ) ধারায় প্রাকৃতিক জলাধারের সংজ্ঞাভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

তারপরও ভরাট, সম্পদের অতিরিক্ত আহরণ, পরিবেশদূষণ, জনসংখ্যার চাপসহ নানা কারণে এ দেশের জলাভূমিগুলোর প্রায় প্রতিটিই কমবেশি বিপদের সম্মুখীন। বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ নানা উদ্ভিদ ও প্রাণী হারিয়ে গেছে। বহু জীব বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে এবং অনেক প্রাণীর আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এখন পর্যন্ত ১২টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে, যার প্রায় সবকটিই জলাভূমি। ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট (রামসার কনভেনশন কর্তৃক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জলাভূমি) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালে টাঙ্গুগুয়ার হাওরকে সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং পরে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালি এবং ধানমন্ডি ও গুলশান লেককে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যদিও এসব জলাভূমি সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশনা দিয়েছে, কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষ উপরিউক্ত জলাভূমি সংরক্ষণে এখনও সুদৃষ্টি দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। জলাভূমি বাঁচাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাংলাদেশের সব জলাভূমির সংরক্ষণই জরুরি।

আইনজীবী

masumbillahlaw06@gmail.com