Print Date & Time : 6 July 2025 Sunday 11:14 am

জাকাত ইসলামি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ

ইয়াছিন আরাফাত : জাকাত ইসলামি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। প্রাণ ছাড়া যেমন প্রাণি বাঁচে না, ঠিক তেমনি জাকাত ছাড়াও ইসলামি অর্থনীতি টিকে থাকতে পারে না। আজকাল সুদভিত্তিক অর্থনীতি আমাদের সমাজের নিঃস্ব ও দরিদ্র মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের অসহায় করে দিচ্ছে। বিপরীতে জাকাতভিত্তিক ইসলামি অর্থনীতি অসহায় ও দরিদ্র মানুষকে স্বাবলম্বী করে তুলতে এবং সাহায্য করতে সদা তৎপর রয়েছে। জাকাতের প্রশংসা এখানেই উচ্চকিত। এছাড়া জাকাত এমন একটি অর্থনীতি ফর্মুলার নির্দেশ দেয়, যে ফর্মুলা বাস্তবায়িত হলে সমাজের ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ঘুচে যাবে সহসাই। সমাজে অসহায় মানুষ আর না খেয়ে মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। এতিম, সহায়সম্বলহীন বনি আদমের আর্তচিৎকার আর শুনতে হবে না।

জাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের তৃতীয় স্তম্ভ। ইসলামি জীবনব্যবস্থায় জাকাতের অবদান অনস্বীকার্য। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম ব্যক্তির নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়ার বছারান্তেই শতকরা আড়াই টাকায় জাকাত আদায় করার বিধান ফরজ করা হয়েছে। সর্বমোট পাঁচটি বস্তুর জাকাত আদায় করতে হয়। তার মধ্যে রয়েছে ১. স্বর্ণ-রৌপ্য, ২. নগদ টাকা-পয়সা, ৩. ফসল ও শস্যাদির ওশর, ৪. বিক্রয় উপযোগী মালামাল, ৫, গরু ছাগল, উট, দুম্বা ইত্যাদি।

মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁর পাক কালামে যত জায়গায় নামাজ কায়েমের ফরমান জারি করেছেন, ঠিক তত জায়গাই জাকাতের কথা তুলে ধরেছেন এবং জাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা করেছেন। কেননা মানবজীবনের প্রধান চালিকাশক্তি হলো অর্থ। অর্থসম্পদ ছাড়া মানবজীবন পরিচালনা করা অসম্ভব। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নামাজের পরই উল্লেখ করেছেন। নামাজি ব্যক্তির নামাজে মন বসে না, যখন পারিবারিক অভাব-অনটনের দুশ্চিন্তা তার মস্তিষ্কের ভেতর ঘুরপাক খায় এবং নামাজে বারবার স্মরণ হয়ে যায়। তাই নামাজ পরিশুদ্ধ করতে জাকাতভিত্তিক অর্থনীতির অবদান অপরিসীম।

জাকাতের মাল আট শ্রেণির মানুষের মৌলিক প্রাপ্য। জাকাত কিন্তু এই আট শ্রেণির মানুষের প্রতি কোনো অনুগ্রহ করা নয়, বরং তাদের হক তাদের বুঝিয়ে দেয়া জাকাতদাতার দায়িত্ব। জাকাত গ্রহীতারা হলোÑ১, ফকির, ২. মিসকিন, ৩. জাকাত উত্তোলনকারী কর্মচারী, ৪. এমন ব্যক্তি যার মন আকৃষ্ট করা যায়, ৫. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, ৬. দাসদাসী মুক্তি, ৭. আল্লাহর পথে লড়াই করা ব্যক্তি ও ৮. মুসাফির। জাকাতের টাকা প্রত্যেক নিসাব পরিমাণ মালের মালিকের ধনসম্পদের ভেতরে এই আট শ্রেণির মানুষের হক লুকিয়ে রয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনÑআর ধনীদের সম্পদে সাহায্য প্রার্থনাকারী এবং বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে। যদি জাকাতদাতা তার জাকাতদানে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে তিনি কাফের বলে গণ্য হবেন। জাকাত না দেয়া ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইসলামি সরকারের যুদ্ধ করার অধিকারও রয়েছে, যার প্রমাণ ইসলামের ইতিহাসে হযরত আবু বকর ( রা.)-এর শাসনামল উল্লেখযোগ্য। খলিফা আবু বকর (রা.) স্বভাবত একজন কোমল হƒদয়ের ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তিনি জাকাত অস্বীকারকারী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, যা ইতিহাসে রিদ্দার যুদ্ধ বলে পরিচিত।

জাকাত অনাদায়ী ব্যক্তির কঠিন শাস্তির বর্ণনা মহান আল্লাহ তায়ালার কোরআনে এবং প্রিয় নবীর অসংখ্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। সুরা তাওবার ৩৪ ও ৩৫নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছেÑ‘আর যারা স্বর্ণ ও রুপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আজাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।’

‘সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে। (সেদিন বলা হবে) এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার।’ নাউজুবিল্লাহ।

জাকাতের মাধ্যমে সমাজে এবং রাষ্ট্রে ধনী-গরিবের দুরত্ব কমে যায়। অসচ্ছল ব্যক্তি তার সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। এতে করে সমাজে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বপ্রেম, হƒদ্যতা ও সৌহার্দ্যরে সম্পর্কও বৃদ্ধি পায়। সমাজে তখন অর্থনৈতিক চাকা সচল হয় এবং সমাজের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষেরা মেরুদণ্ড সোজা করে জীবনযাপন করতে সুযোগ পায়। তাছাড়া জাকাত আদায়কারী জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদের পবিত্রতাও বৃদ্ধি করতে পারে। কেননা আল্লাহ তায়ালা সুদকে ধ্বংস করে দেন আর জাকাতকে দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি করে দেন।

জাকাতবিহীন অর্থব্যবস্থা এক নব্য জাহেলি অর্থব্যবস্থা। জাকাতদানে অনীহা প্রদর্শন করত জাহেলি যুগের ইহুদিরা। কেননা তারা আরব সমাজে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের প্রচলন ঘটিয়ে রাতারাতি নিজেরা অর্থবিত্ত, শান-শওকত ও আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছিল। বিপরীতে একশ্রেণির মানুষ তাদের সুদে পরিমাণ হিসাব করতে জীবনকে তছনছ করে ফেলেছিল। আজও যারা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় জাকাতের প্রচলন করে না এবং করতে চায় না, তারাও পরোক্ষভাবে ইহুদিদের প্রতিনিধিত্ব করছে, যা খুবই লজ্জাজনক।

সর্বোপরি বলা যায়, একটি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে সুখ ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থার বিকল্প অন্য কোনো অর্থব্যবস্থার রূপরেখা ইসলামি শরিয়তে নেই। জাকাতবিহীন অর্থনীতি একটি অপরিপক্ব ও নড়বড়ে অর্থনীতি। সুতরাং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের উচিত অর্থনীতির ভিত্তি সুদৃঢ করতে তাদের গচ্ছিত সম্পদের যথাযথ জাকাত আদায় করে দেয়া। মহান মালিক আমাদের সবার জাকাতের কল্যাণ অনুধাবন করার তৌফিক দিন।

শিক্ষার্থী

আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়