জাকাত মানে শাড়ি-লুঙ্গি কিংবা ঈদ বোনাস নয়

মুসলিমদের পবিত্র ধর্ম ইসলাম ও ধর্মগ্রন্থ কোরআনের নির্দেশনা অনুসারে দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাত একটি আদর্শ পদ্ধতি। বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা জাকাত আদায় হয়, কিন্তু দারিদ্র্যের হার কমছে না, বরং দিন দিন বেড়েই চলছে। আর এই বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ হচ্ছে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ না করা। আমাদের দেশে জাকাতের অর্থ দিয়ে অধিকাংশ নাগরিকই লুঙ্গি-শাড়ি-পাঞ্জাবি প্রদান করে থাকেন। আর এই পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সবার ধারণা, জাকাত মানেই শাড়ি-লুঙ্গি কিংবা ঈদের সেলামি, যা ভুল ধারণার অন্তর্ভুক্ত।

জাকাত আবশ্যকীয় বিধান (ফরজ) করার উদ্দেশ্য হলোÑক. গরিবের প্রয়োজন পূর্ণ করা, অভিশপ্ত পুঁজিতন্ত্রের মূলোৎপাটন করা, সম্পদ কুক্ষিগত করার মানসিকতাকে শেষ করে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি করা; খ. দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা; গ. চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইসহ সব রকম অভাবজনিত অপরাধের মূলোৎপাটন করা, গরিব-ধনীর মাঝে সেতুবন্ধ সৃষ্টি করা; ঘ. সম্পদের বরকত ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা; ঙ. কৃপণতার মতো অসৎ গুণ থেকে নিজেকে পবিত্র করা; ছ. সম্পদের পরিধি বৃদ্ধি করা প্রভৃতি। কিন্তু  আমাদের দেশে জাকাতের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও বণ্টনের অভাবে। অথচ জাকাতের সুষ্ঠু বণ্টন করার মধ্য দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব। দরিদ্র মানুষকে এমনভাবে জাকাত দিতে হবে যেন সে ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়ে পরবর্তী বছর নিজেই জাকাত দিতে পারে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায়ের বিষয়ে বহুবার নির্দেশনা দিয়েছেন। হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) বলেছেন, জাকাত আদায়ের মাধ্যমে সম্পদ কমে না, বরং বৃদ্ধি পায়। এই জাকাত ফরজ হওয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, ৭.৫ ভরি স্বর্ণ, ৫২.৫ ভরি রুপা বা সমমূল্যের প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদের মালিক হলে এবং এ অবস্থায় এক বছর অতিক্রান্ত হলে, তাকে ইসলামি পরিভাষায় নেসাব বলে। কারও নেসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর পর্যন্ত থাকলে তার ওপর জাকাত ফরজ। জাকাত ফরজ হওয়া ব্যক্তিদের যেমন জাকাত আদায় করা জরুরি, তেমনি যারা জাকাতের অর্থ গ্রহণের অধিকারী, তাদেরকে লুঙ্গি-শাড়ি না দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করিয়ে দেয়া দরকার। হতে পারে সেটা জায়গা কিনে দেয়া, গৃহ নির্মাণ করে দেয়া, ব্যবসা করার মতো পুঁজি কিংবা কৃষিকাজ করার মতো জায়গা ও উপকরণ কিনে দেয়া। এমনকি তাদের প্রয়োজনে চিকিৎসা ব্যয় বহন করা। আর এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে জাকাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হলেই দারিদ্র্য দূর করে অর্থনৈতিক সমতার সমাজ গঠন করা সম্ভব।

আমাদের দেশে প্রতি বছর ইদুল ফিতরের সময়ে শাড়ি ও লুঙ্গি প্রদানের মাধ্যমে জাকাত আদায় করতে দেখা যায়। জাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে এলাকার মানুষকে শাড়ি ও লুঙ্গি প্রদান করেন। অধিক মানুষ জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি পেলেও তাদের কারওই এতে প্রয়োজন মেটে না। এভাবে জাকাত প্রদান করা মানে দরিদ্র ব্যক্তিকে দারিদ্র্যপূর্ণ অবস্থায় ফেলে রেখে প্রতি বছরই শাড়ি-লুঙ্গি দিয়ে জাকাত আদায় করা। এভাবে কখনোই জাকাতের উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। এ অবস্থায় জাকাত-গ্রহীতাদের শাড়ি-লুঙ্গি কিংবা যৎসামান্য অর্থ না দিয়ে নিজেদের উদ্যোগে কিংবা ইসলামী ফাউন্ডেশনের মধ্যস্থতা কিংবা জাকাত ব্যবস্থাপনায় কমিটি গঠন করে অসহায় সম্বলহীন দরিদ্র মানুষদের জন্য জায়গা, গৃহ ও ব্যবসার জন্য নগদ অর্থ প্রদানের মাধ্যমে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরানো সম্ভব।

প্রতি বছর জাকাতের অর্থায়নে যদি দেশব্যাপী এক হাজার পরিবারকেও স্বাবলম্বী করা যায়, তাতে দেশ থেকে চিরতরে দারিদ্র্য দূর করতে বেশি সময় লাগবে না। আমাদের উচিত, উদার মন-মানসিকতার অধিকারী হওয়া। কেননা, এই সমাজে লোক দেখানোর জন্য কিংবা নিজেকে মহান প্রমাণের জন্য মানুষ জাকাত প্রদান করে থাকে। তাই অধিক লোকের মাঝে নামমাত্র অর্থ-কাপড় প্রদান না করে একজন মানুষকেও স্বাবলম্বী করতে পারলে সেটিই হবে জাকাত আদায়ের সর্বোকৃষ্ট উদাহরণ। নামমাত্র সহায়তা করে একটি দরিদ্র পরিবারকে দারিদ্র্যের মাঝেই ফেলে রাখার চেয়ে সুনাগরিক হিসেবে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সহযোগিতা করা সবচেয়ে জরুরি। তাহলেই দারিদ্র্যমুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভ‚মি।

জুবায়ের আহমেদ

শিক্ষার্থী, বিজেম

কাঁটাবন, ঢাকা