সুধীর বরণ মাঝি: আজকের জাটকাই আগামী দিনের সুস্বাদু পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ বড় রুপালি ইলিশ। এখন যে হারে জাটকা নিধন চলছে, তাতে ইলিশ আগামী দিনে বইয়ের পাতা ও জাদুঘরেই দেখা যাবে। জেলেরা অবাধে জাটকা নিধন করে চলছে। বাজারে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে জাটকা। শুধু বাজারেই নয়, গ্রামের অলিগলিতেও ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে জাটকা। কিছু বলতে গেলেই বিক্রেতারা চড়াও হয়ে ওঠে।
আমরা এই অবস্থা দেখতে চাই না, আমরা এর প্রতিকার চাই। মেঘনায় যে হারে জাটকা নিধন চলছে, তা বন্ধ হওয়া দরকার। তা না হলে ভবিষ্যতে ইলিশ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
শুধু ঘোষণা দিয়ে জাটকা রক্ষা করা যাবে না, ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়নের সফল উদ্যোগও নিতে হবে। আমরা প্রচণ্ড লোভের বৃত্তে আটকে পড়ে গেছি। এই লোভের বৃত্ত ভাঙতে না পারলে জাটকা রক্ষা করা আদৌ সম্ভব নয়।
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ, জাতীয় সম্পদ এবং ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রথম। একেকটি জাটকা পাঁচ-সাত মাসের মধ্যে ৭০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশে পরিণত হয়। একটি জাটকা পাঁচ টাকা আর একটি ইলিশ ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা। জাটকা রক্ষা করতে পারলেই ইলিশ হয় এবং তা জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়।
ইলিশ আমাদের পুষ্টিচাহিদা পূরণ করে। জাটকা রক্ষা করতে পারলেই ইলিশের উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদ এবং ঐতিহ্যের একটি। একে রক্ষা করা এবং এর উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করা প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। ডিম ছাড়ার সময় এবং প্রজনন মৌসুমে নদীতে সকল প্রকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও কতিপয় অসাধু ব্যক্তি অতিরিক্ত মুনাফার আশায় কখনও গোপনে এবং কখনও প্রশাসনের যোগসাজশে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে জাটকাসহ অন্যান্য মাছ ধরে আমাদের মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
জাটকাসহ নদীর অন্যান্য মাছকে রক্ষা করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক নজরদারি, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং এর সঙ্গে নদীর নাব্য ও গতিকেও সচল রাখতে হবে। নিষিদ্ধ মৌসুমে নদীতে সকল প্রকার মাছ না ধরার অভিযানকে শতভাগ সফল করতে হবে। এই অভিযানকে সফল করার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি সচেতন নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। নিয়মিত অভিযান পরিচালিত না হওয়ার ফলে জেলেরা অবাধে মাছ ধরার সুযোগ পাচ্ছে। চাঁদপুর লঞ্চঘাটের পর থেকে গজারিয়া পর্যন্ত এবং হাইমচরের চরভৈরবী, ঈশানবালা, মাঝের চর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা ও বরিশালে অনেকটা প্রকাশ্যে প্রশাসনের নাকের ডগায় দিনের বেলাতেই নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়ে অবাধে জাটকাসহ অন্যান্য মাছ নিধন চলছে। মহনপুর ও গজারিয়ার জেলেরা অতিমাত্রায় বেপরোয়া ও আগ্রাসী। অবৈধভাবে জাটকা ধরার মহোৎসব চলছে। জাটকাসহ নদীর অন্যান্য মাছ রক্ষার অভিযানকে সফল করতে এবং মৎস্য সম্পদকে রক্ষা করতে হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ অন্যান্য সকল টহল অভিযানকে আরও জোরদার করতে হবে এবং প্রত্যেকের কাজের সমন্বয় করতে হবে। প্রশাসনের কাজের জবাদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল উৎপাদন এবং আমদানি বন্ধ করতে হবে যে কোনো মূল্যে। জাটকা রক্ষায় প্রশাসনের কোনো রকম অবহেলা পরিলক্ষিত হলে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। জেলেদের বোঝাতে হবে, এই ইলিশের মালিক জেলেরাই, তাই তাদেরই ইলিশ রক্ষা ও লালনপালনের দায়িত্ব নিতে হবে এবং এক্ষেত্রে সরকার ও প্রশাসন তাদের সর্বোচ্চ সহযোগী। প্রশাসন যত কঠোর হবে, জাটকা ও ইলিশ রক্ষার কার্যক্রম তত সফল হবে। জাটকা রক্ষা করতে পারলে জেলেদের জীবনে যেমন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও নিরাপত্তা আসবে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকাও সচল হবে এবং ডলার সংকট মোকাবিলায়ও ভূমিকা রাখবে। আমরা জাটকা রক্ষার সফল অভিযান দেখতে চাই, তা যতই কঠোর ও কঠিনই হোক।
শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়
চাঁদপুর