নিজস্ব প্রতিবেদক:জানুয়ারিতে এখন পর্যন্ত এক দিনের জন্যও নির্মল বাতাস পাননি রাজধানীবাসী। পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এ তথ্য দিয়েছে। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে নানা তথ্য তুলে ধরে বাপা। সংগঠনটি বলছে, রাতে ঢাকা শহরের বাতাসের মান সবচেয়ে খারাপ থাকে। রাত ১০টার পর পণ্যবাহী ট্রাকের প্রবেশকে এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য ও দুর্যোগ মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি সামনে রেখে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।
কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের অর্থাৎ গত ৬ বছরের জানুয়ারির বায়ুমান সূচকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড় বায়ুদূষণের পরিমাণ বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২২ সালে জানুয়ারির প্রথম ২৫ দিনের গড় বায়ুমান সূচক ২১৯ দশমিক ৫২-তে এসে দাঁড়িয়েছে; যা খুবই অস্বাস্থ্যকর।
অধ্যাপক মজুমদার বলেন, জানুয়ারিতে ঢাকার মানুষ এক দিনের জন্যও ভালো বাতাস পাননি, বাতাসের মান বেশিরভাগ সময় ‘অস্বাস্থ্যকর’ থেকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় ছিল এবং গত ছয় বছরের মধ্যে ঢাকার মানুষ মাত্র ৩৮ দিন ভালো বাতাস পেয়েছেন।
ক্যাপসের তথ্য বলছে, ঢাকা শহরে বিকাল ৪টার পর থেকে বাতাসের মান খারাপ হতে শুরু করে, যা রাত ১১টা থেকে ২টার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে। গত
ছয় বছরে বাতাসের মান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাত ১টায় বায়ুমান সূচক থাকে ১৬২; যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বোচ্চ। রাত ১০টার পর উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে প্রচুর পণ্যবাহী ট্রাক ঢাকা শহরে প্রবেশ করে, যার কারণে এসব যানবাহন থেকে রাতে প্রচুর বায়ুদূষণ হয়।
অধ্যাপক মজুমদার বলেন, ঢাকা শহরের রাস্তাগুলোয় রাতের বেলায় ঝাড়ু দেয়ার নিয়ম চালু রয়েছে; যার কারণে বাতাসে ধুলাবালি উড়তে থাকে। রাতে যেহেতু দিনের চেয়ে তাপমাত্রা কম থাকে, সেহেতু ধুলাবালি বাতাসে বেশি সময় ধরে অবস্থান করে। ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের গবেষণার তথ্য দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ক্যাপসের পরিচালক জানান, ২০২১ সালে ঢাকা শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত ছিল তেজগাঁও (প্রতি ঘনমিটারে ৭০ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫)। এর পরের অবস্থানে ছিল শাহবাগ (প্রতি ঘনমিটারে ৬৮ মাইক্রোগ্রাম)।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে আহসান মঞ্জিল, আবদুল্লাহপুর, মতিঝিল, ধানমন্ডি-৩২, সংসদ ভবন, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ এবং গুলশান-২Ñএই এলাকাগুলোয় ক্ষতিকর বস্তুকণা পিএম-২.৫-এর গড় পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫৭, ৬২, ৬০, ৬৩, ৫৯, ৬১, ৬৬ ও ৬৫ মাইক্রোগ্রাম; যা নির্ধারিত মান মাত্রার প্রায় ৫ গুণ বেশি। সভাপতির বক্তব্যে বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ঢাকা নগরের বায়ুর মান ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে হতে বিপজ্জনক পর্যায়ে যাওয়ার পরও এ ব্যাপারে নাগরিকদের অবগত না করায়, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতা রয়েছে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ঢাকা শহরের বায়ু সম্পর্কে যথাযথ তথ্য যথাসময়ে সাধারণ মানুষকে অবগত করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকায় একটি মানবিক বিপর্যয় হচ্ছে এবং আমরা সেই উন্নয়ন চাই না, যে উন্নয়ন জীবনকে হুমকিতে ফেলে দেয়।
বাপার নির্বাহী কমিটির সদস্য এম এস সিদ্দিকী বলেন, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের ফলে ঢাকার দূষণ বেশি হচ্ছে এবং এই দূষণ কমানোর জন্য ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, সরকার নিজেদের পরিকল্পনা ও বাজেট যথাযথ খরচ করলে নির্মাণের যে দূষণ সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
বাপার নির্বাহী কমিটির সদস্য ইবনুল সাঈদ রানা বলেন, গত এক দশক ধরে ব্যবহƒত সব ধরনের মোবাইল ফোন ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর ব্যাটারিগুলো কীভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয় এবং সেগুলো থেকে কী পরিমাণ দূষণ হয়, তার সঠিক হিসাব বের করতে তিনি সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোকে অনুরোধ জানান।
ক্যাপসের গবেষণা শাখার প্রধান আব্দুল্লাহ আল নাঈম বলেন, ধুলা-দূষণের পাশাপাশি ঢাকা শহরে গ্যাসীয় দূষণ এবং বাতাসে ভারী ধাতু বিশেষ করে সিসা দূষণের পরিমাণও বেড়ে চলেছে। এ ক্ষেত্রে সিসা দূষণের অন্যতম উৎস ব্যবহƒত ব্যাটারি এবং সালফারযুক্ত গ্যাসোলিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে তিনি জোর দাবি জানান। সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল।
বায়ুদূষণের ভয়াবহতা থেকে উত্তরণের জন্য ১৫টি সুপারিশ তুলে ধরে বাপা। সুপারিশগুলো হলোÑশুষ্ক মৌসুমে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নির্মাণকাজের সময় স্থানটি ঘেরাও দিয়ে রাখতে হবে ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নিতে হবে। রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা যেতে পারে। অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে। এছাড়া রয়েছে ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ। প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে এবং ছাদ বাগান করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে। ঢাকার আশপাশে জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে। আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করতে হবে। আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে ‘স্যান্ড ব্লকে’র ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে। সিটি গভর্ন্যান্স প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।
নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যতদ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষণ স্টেশনের (ক্যামস) ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে হবে। এছাড়া বায়ুদূষণের পূর্বাভাস দেয়ার প্রচলন করতে হবে। সর্বোপরি সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়য়ুদূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্যনির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারাদেশের বায়ুদূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা। পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করতে হবে।