জাপান-কোরিয়ার বাণিজ্যবিরোধ ও সম্ভাব্য প্রভাব

মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী: জাপান ও কোরিয়া দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। রাষ্ট্র দুটোর সম্পর্ক অম্লমধুর। এ সম্পর্কের সূচনা অনেকদিন আগে। বিশ শতকের শুরুর দিকে জাপানের অধীন উপনিবেশ ছিল কোরিয়া। সেই সময়কালে জাপানি শাসন কোরিয়ানদের কাছে এখনও দুঃসময় হিসেবে বিবেচিত। এ সম্পর্ক শিকড় এতটাই গভীর যে, বহু যুগ পর এখনও কোরীয় জনগণ মনে মনে জাপানের সে সময়ের শাসনকে ঘৃণা করে। তবে ঐতিহাসিক এ বিরূপ সম্পর্ক সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই দুটো দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে।
২০১৮ সালে জাপান থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার আমদানি-রফতানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫৪ দশমিক ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৩২ দশমিক ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কোরিয়ায় জাপানি উপনিবেশ শাসনের অবসানের পর থেকে কোরীয় সরকার ও জনগণের লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জাপানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া। এই এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোরিয়া-জাপানের অর্থনৈতিক নীতি ও কাঠামোর অনুসরণ, অনুকরণ করলেও তাদের চেষ্টা ছিল মানে এবং গুণে উন্নততর দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন করে জাপান থেকে এগিয়ে যাওয়া। সেই চেষ্টা কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছে সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বিশ্ববাজারে কোরিয়ার স্যামসাং, এলজি, হুন্দাই কার ইত্যাদি পণ্য বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে সেরা তালিকাভুক্ত কয়েকটি পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কোরীয় ও জাপানের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবারও পুরোনো ক্ষতের বিষবাষ্পের উত্তাপ ছড়াচ্ছে। সেই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক টানাপড়েনকে এখন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
জাপান সরকার জুলাই ২০১৯ সালে কোরিয়া কর্তৃক আমদানিকৃত কেমিক্যাল পণ্যের ওপর শুল্ক বাধা আরোপ করেছে; যা স্মার্টফোন উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহƒত হয়। এর ফলে কোরিয়ায় সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং এর দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া কোরিয়ার অর্থনীতির ওপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলবে। সেমিকন্ডাক্টর ও স্মার্টফোনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের মূল তিনটি উপাদান জাপান থেকে কোরিয়ায় রফতানিতে বাধাগ্রস্ত হলে কোরিয়া তার বাজার হারানোর আশঙ্কা করছে। উল্লেখ্য, জাপান এই তিনটি কাঁচামালের ৭০-৯০ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে।
কোরীয় অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাব মতে, এই তিনটি কাঁচামালের জোগান ৩০ শতাংশ হ্রাস পেলে দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপি প্রায় দুই দশমিক দুই শতাংশ হ্রাস পাবে, যার পরিমাণ হবে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ। এ বিবেচনায় কোরীয় সরকার জাপানের এ কার্যক্রম গ্রহণের প্রতিবাদস্বরূপ বিষয়টিকে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা তথা ডব্লিউটিও-এর বোর্ডে উত্থাপন করতে যাচ্ছে।
তার মানে বিরোধের বিষয়টি এখন দ্বিপক্ষীয় ইস্যু ছাড়িয়ে একটি বৈশ্বিক বিষয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। তবে বিষয়টি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে উত্থাপিত হলে এর সমাধান দীর্ঘমেয়াদি ইস্যুতে পরিণত হবে। অর্থাৎ নেতিবাচক সম্পর্কটি আরও দীর্ঘায়িত হবে এবং বিশ্ববাজারে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হবে।
এমনিতেই চীন ও আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, তার ওপর কোরিয়া-জাপানের এ বাদানুবাদ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কাউন্সেলর (বাণিজ্য উইং)
বাংলাদেশ দূতাবাস, সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া