নোমান বিন হারুন, জাবি: আজ ২ মার্চ শেষ হতে চলেছে দেশের প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের মেয়াদ। ২০১৮ সালের পর টানা দ্বিতীয়বারের মত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। দায়িত্ব পালনকালে নানা ঘটনার জন্য আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন এই উপাচার্য। তার দায়িত্বের শেষপ্রান্তে এসে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণ মেলাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৪ সালের ২ মার্চ নিয়োগপ্রাপ্ত হন অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। শুরুর দিকে শিক্ষার্থীবান্ধব ও সংস্কৃতিমনা হিসেবে পরিচিতি পেলেও দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা অভিযোগে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন জাবির ১৮ তম এই উপাচার্য। এমনকি দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুর দিকে ভিসিবিরোধী আন্দোলনের মুখে পড়েন তিনি।
আলোর মুখ দেখেনি জাকসু নির্বাচন: ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পরের বছরই প্রথম জাকসু নির্বাচন হয়। এরপর ১৯৭৪, ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮৯, ১৯৯০ ও ১৯৯১ সালসহ মোট আটবার নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯২ সালে শেষবারের মতো নির্বাচন হয়। কিন্তু ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাবে ছাত্ররা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালালে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ভেঙে দেয় প্রশাসন। আন্দোলনের মুখে ২০১৯ সালের নভেম্বরের মধ্যে জাকসু নির্বাচনের ঘোষণা দেন উপাচার্য ফারজানা ইসলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেবছরই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু গত বছর তিনি এলপিআর এ চলে গেলে অনিশ্চয়তায় পড়ে জাকসু নির্বাচন।
হয়নি সমাবর্তন: জাবিতে ৫০ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র পাঁচবার। সর্বশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ২৬ বছরে ১৯৯৭ সালে প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০০১ সালে দ্বিতীয়, ২০০৬ সালে তৃতীয়, ২০১০ সালে চতুর্থ এবং ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত হয় সর্বশেষ সমাবর্তন। উপাচার্য ২০২০ সালের শেষের দিকে ষষ্ঠ সমাবর্তনের সম্ভাবনার কথা জানালেও শেষ পর্যন্ত তা আয়োজনে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
ভারপ্রাপ্তের ভারে ন্যুব্জ জাবি: উপাচার্য ফারজানা ইসলামের আমলেই সবচেয়ে বেশি ভারপ্রাপ্ত দ্বারা পরিচালিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার থেকে শুরু করে প্রক্টর, প্রধান প্রকৌশলী, কম্পট্রোলার, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন এবং জনসংযোগ অফিসের মত গুরুত্বপূর্ণ বেশিরভাগ অফিস চলছে ভারপ্রাপ্তদের দ্বারা। এছাড়া ৭৩ অ্যাক্টের ২৫(৫) ধারা অনুযায়ী ডিনের মেয়াদ দুই বছর। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘদিন অনুষ্ঠিত হয়নি কোন ডিন নির্বাচন।
সবচেয়ে কম অফিস: করোনা মহামারীর অযুহাতে দীর্ঘ ৬৪০ দিন সশরীরে দাপ্তরিক কাজে অনুপস্থিত ছিলেন জাবি উপাচার্য। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজে নেমে এসেছে কচ্ছপগতি।
অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি: শুরু থেকেই ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে’ অনিয়ম ও নির্মাণকাজকে অপরিকল্পিত বলে আন্দোলনে সরব ছিল শিক্ষার্থীরা। এমনকি নির্মাণকাজে ছাত্রলীগকে দুই কোটি টাকা ঈদ-সালামি দেয়ার অভিযোগ আসে। এ অভিযোগের জের ধরে পদ হারান ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক।
শেষ সময়ের নিয়োগ: দুই মেয়াদের শেষ সময়ে এসে তড়িঘড়ি করে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন উপাচার্য ফারজানা ইসলাম। মেয়াদের শেষ বছরের শুরুতেই অন্তত ৪৭টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে ৩৭ জন শিক্ষক এবং ১০ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এসব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। অভিযোগ রয়েছে নিজ মতাদর্শের লোক নিয়োগ দিয়ে দল ভারী করছেন তিনি।
ভর্তি ফরমের অনিয়ম তদন্তে ইউজিসি ও দুদক: জাবিতে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ¯œাতক ভর্তি ফরম বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আয় হয়েছিল ২০ কোটি টাকা। তার মধ্যে পরীক্ষা আয়োজন প্রক্রিয়ায় ১০ কোটির বেশি ব্যয় হয়। আর দুই কোটি টাকা ব্যয় হয় অন্যান্য খাতে। বাকি আট কোটি এক লাখ ২২ হাজার টাকা শিক্ষক ও ভর্তি পরীক্ষায় যুক্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভাগবাটোয়ারা করে নেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগে তদন্তে নেমেছে ইউজিসি ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দেশের শীর্ষস্থানীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী উপাচার্য কে হবেন এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে চলছে জল্পনা-কল্পনা। তবে, ১৯৭৩ এর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টে টানা তৃতীয়বার উপাচার্য হওয়ার কোন উল্লেখ নেই। দেশের ইতিহাসেও এমন কোন নজির নেই। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে গবেষণা ও শিক্ষার্থীবান্ধব উপাচার্য চান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
যদিও ভিসির রুটিন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. নুরুল আলমকে। পরবর্তী উপাচার্য নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত তিনি এই পদে দায়িত্ব পালন করবেন।
মঙ্গলবার (১ মার্চ) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সরকারি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপসচিব মো. মাহমুদুল আলম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানানো হয়।