Print Date & Time : 4 July 2025 Friday 10:59 pm

জামানত জটিলতায় ঋণ পান না ৬৭% কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (সিএমএসএমই) শিল্প। জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশই আসে এখান থেকে। কিন্তু ঋণ জটিলতার কারণে অনেকাংশেই বিকশিত হতে পারছে না এ খাত। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪ সালের মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের মোট ঋণের ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল। তবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তা ১৫ শতাংশেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএমের) এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু জামানত-সংক্রান্ত জটিলতায় এ খাতের প্রায় ৬৭ শতাংশ উদ্যোক্তা ঋণ পাচ্ছেন না।
‘ব্যাংকিংয়ের জন্য সিএমএসএমইর প্রস্তুতি: সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় গতকাল মঙ্গলবার এ বিষয় উঠে আসে। বিআইবিএম আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে উদ্বোধন করেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘সিএমএসএমই খাতের অনেক উদ্যোগ অনানুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত হয়। ফলে এসব উদ্যোক্তার অধিকাংশেরই ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন, ভ্যাট নিবন্ধন অথবা জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে ব্যবসার সংযোগ নেই। এ আনুষ্ঠানিক পরিচয়ের অভাবে তারা ব্যাংকিং সুবিধা ও সরকারি প্রণোদনা স্কিমের সুবিধা পান না। এ ছাড়া আর্থিক তথ্য উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়নের সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে বড় বাধা। অনেক সময় উদ্যোক্তারা নগদ প্রবাহের রেকর্ড কিংবা ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ করেন না। ফলে তাদের ক্ষেত্রে ঋণ প্রক্রিয়াকরণ ও মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করা সম্ভব হয় না। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেকেই মৌখিক চুক্তি ও অনানুষ্ঠানিক আর্থিক কর্মকাণ্ডের ওপর বেশি নির্ভর করেন। ফলে এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানে আগ্রহী হয় না।’
গোলটেবিল আলোচনায় উত্থাপিত গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন জামানত-সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে। উদ্যোক্তাদের ৬৬ দশমিক ৮৬ শতাংশই এ কারণে ঋণ পান না। এছাড়া ৫৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ উদ্যোক্তা ঋণ নেয়ার জন্য জামিনদার বা গ্যারান্টার পান না। উচ্চসুদ নিয়ে সমস্যায় ভোগেন ৩২ দশমিক ২৫ শতাংশ উদ্যোক্তা। আবার ঋণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানেন না উদ্যোক্তাদের ১৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। আর ব্যবসা সম্পর্কে সঠিক পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে ৫ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশের।
গবেষণা প্রবন্ধে আরও বলা হয়, গ্রামীণ এলাকার অনেক উদ্যোক্তা আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থার আওতায় এলে কর পরিশোধ, আইনি দায়বদ্ধতা বা নিরীক্ষণের ভয়ে থাকেন, যা তাদের নিবন্ধন ও ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হতে নিরুৎসাহিত করে। আবার অধিকাংশ উদ্যোক্তা মনে করেন, ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত ডকুমেন্ট দিতে হয়, যা তাদের পক্ষে জোগাড় করা কঠিন। ফলে এনজিওর মতো সহজ শর্তে ঋণ দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারস্থ হন তারা।
যোগাযোগের দক্ষতা ও ইউটিলিটি সেবা-সংক্রান্ত জটিলতা সিএমএসএমই খাতকে পিছিয়ে রাখছে বলে এ গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। এ খাতের ৬২ শতাংশ ৪৩ শতাংশ উদ্যোক্তার বিপণন ও বিতরণ নেটওয়ার্ক নেই। এ ছাড়া ঘনঘন বিদ্যুৎবিভ্রাট ও ভোল্টেজের ওঠানামাও উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটায়। আর সীমিত ব্যবসায়িক প্রশিক্ষণ, নেটওয়ার্কিংয়ের অভাব এবং ব্যবসায়িক ও আর্থিক বিষয়ে পুরুষ সদস্যদের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে নারী উদ্যোক্তারা নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই ও স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগের পরিচালক নওশাদ মোস্তফা বলেন, ‘অনানুষ্ঠানিক খাতে ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশে বিদ্যমান নানা আইন রয়েছে। কোথাও কোথাও ট্রেড লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা আছে। সেসব জটিলতা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি দ্রুতই সমস্যা নিরসন হবে।’
উদ্যোক্তাদের পর্যাপ্ত তথ্য দেয়ার জন্য ব্যাংকগুলোয় আলাদা ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দিয়ে বিআইবিএমের ফ্যাকাল্টি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই অর্থনীতি বিভাগের সাবেক পরিচালক মোর্শেদ মিল্লাত বলেন, ‘ব্যাংকগুলোয় এসএমই, কৃষি ও টেকসই ফাইন্যান্সিংসহ বিভিন্ন ডেস্ক থাকতে হবে, যাতে উদ্যোক্তারা তাদের প্রয়োজনীয় সব তথ্য পান।’
ব্যাংকের ঋণ প্রদান ও গ্রহণের মধ্যে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, ‘ব্যাংকগুলো বলছে, তারা ঋণ দিতে চায় কিন্তু দিতে পারছে না। আবার উদ্যোক্তারা বলেন, তারা ঋণ নিতে চান কিন্তু পাচ্ছেন না। এখানে দুই পক্ষের মধ্যেই একধরনের শূন্যতা রয়েছে। এগুলো কমিয়ে আনতে হবে। সিএমএসএমই খাতের ঋণ প্রক্রিয়া আরো সহজ করতে হবে।’
বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. মো. আক্তারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের ডিএমডি হাসান খালেদ এবং ব্র্যাক ব্যাংকের এএমডি ও এসএমই ব্যাংকিং প্রধান সৈয়দ আব্দুল মোমেন প্রমুখ।