নিজস্ব প্রতিবেদক : ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও তহবিল অপব্যবহার রুখতে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে সরকার। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে তহবিল জালিয়াতির ক্ষেত্রে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী হবেন। এমনকি প্রয়োজনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নেয়ার সুযোগও রাখা হয়েছে।
গত ১৭ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর ৯ মে সরকার গেজেট আকারে অধ্যাদেশটি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, কোনো তফসিলি ব্যাংকের সম্পদ বা তহবিল প্রতারণার মাধ্যমে ব্যবহৃত হলে দায়ী ব্যক্তি যেই হোন না কেন, তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবে।
অধ্যাদেশে আরও বলা হয়েছে, দুর্বল কোনো ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে। সেইসঙ্গে প্রয়োজন হলে ব্যাংকের শেয়ার, সম্পদ বা দায় তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তরেরও সুযোগ থাকবে। ব্যাংক কার্যত দেউলিয়া হলে বা আমানত পরিশোধে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারবে।
এ লক্ষ্যে গঠন করা হচ্ছে সাত সদস্যবিশিষ্ট ‘ব্যাংক খাত সংকট ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল’, যার নেতৃত্বে থাকবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। কমিটিতে অর্থসচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, বিএসইসি চেয়ারম্যান, সংসদবিষয়ক সচিব এবং দুজন ডেপুটি গভর্নরও থাকবেন। প্রতি তিন মাস অন্তর কাউন্সিল সভা করবে এবং সংকট মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণ করবে।
এ ছাড়া অধ্যাদেশে ‘ব্রিজ ব্যাংক’ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে, যা দুর্বল বা দেউলিয়া ব্যাংকের কার্যক্রম সাময়িকভাবে চালিয়ে নেবে। পরে এগুলো বিক্রিও করা যেতে পারে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিল হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক আদালতের অনুমোদন নিয়ে একজন অবসায়ক নিয়োগ দেবে। ব্যাংক নিজে থেকেও অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া নয়। অবসায়নের সাত কর্মদিবসের মধ্যে আমানত ও দুই মাসের মধ্যে অন্যান্য দায় মেটাতে হবে। এই নতুন অধ্যাদেশের মাধ্যমে ব্যাংক খাতে জবাবদিহি বাড়বে এবং দুর্নীতির লাগাম টানা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ব্যাংকের মালিক বা সুবিধাভোগীরা যদি কোনোভাবে নিজস্ব স্বার্থে ব্যাংকের তহবিল ব্যবহার করেন, বা অন্যের স্বার্থে প্রতারণামূলক ব্যবহার করেন, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেই ব্যাংকের রেজল্যুশনের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত হলে সরকার চাইলেই সেই ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে এবং তা সরকারের মালিকানায় চালাতে পারবে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যাংক আর কার্যকর না থাকে বা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে, আমানত ফেরত দিতে না পারে কিংবা দেউলিয়া হওয়ার পথে থাকে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক আদালতে আবেদন করে তার লাইসেন্স বাতিল ও অবসায়নের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে।
এক্ষেত্রে আদালত একজন অবসায়ক নিয়োগ দেবে, যিনি ব্যাংকের সম্পদ লিকুইডেট করে দায় পরিশোধের কাজ করবেন। লাইসেন্স বাতিল হলে সুদ ও অন্যান্য মাশুলও আর প্রযোজ্য থাকবে না।
তবে কোনো ব্যাংক চাইলে স্বেচ্ছায় অবসায়নের পথে যেতে পারবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি বাধ্যতামূলক। নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, লাইসেন্স প্রত্যাহারের সাত কর্মদিবসের মধ্যে আমানত ফেরত দিতে হবে এবং দুই মাসের মধ্যে বাকি দায় নিষ্পত্তি করতে হবে।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নতুন অধ্যাদেশটি সময়োপযোগী। এর ফলে সরকার প্রয়োজনে ব্যাংক অধিগ্রহণ করতে পারবে, যা গ্রাহকের আস্থাকে সুদৃঢ় করবে।’ তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘আইনের প্রয়োগে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে, তা না হলে খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ শুধু একটি আইন নয়, বরং ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের শক্ত অবস্থান। এর মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ ও দায়িত্বহীন পরিচালকদের ওপর চাপ বাড়বে এবং সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে-এমনটিই প্রত্যাশা।