গ্লোবাল অ্যাটায়ারের শুল্ককর ফাঁকি ৫৮.৭৯ কোটি টাকা

জালিয়াতি করে অনুমোদনহীন এইচএস কোডে পণ্য খালাস

রহমত রহমান: বন্ড লাইসেন্সে এইচএস কোড অন্তর্ভুক্ত নেই। কিন্তু সেই ৪২টি এইচএস কোডে কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান জানলেও জালিয়াতি বা মিথ্যা ঘোষণায় সেই কাঁচামাল খালাস নিয়েছে শুল্কমুক্ত সুবিধায়। প্রায় ৬৭ কোটি টাকার এই কাঁচামালে প্রযোজ্য শুল্ককরই প্রায় ৫৬ কোটি টাকা। নিরীক্ষায় অনিয়ম উঠে আসার পর লাইসেন্সে সেই এইচএস কোড অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আবার পোশাক ওয়াশিং করতে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা হয় কেমিক্যাল। কিন্তু সেই কেমিক্যালের সঠিক ব্যবহার করা হয়নি। আমদানি করা সেই কাঁচামালে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় এক কোটি ২৮ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি সেবা গ্রহণের বিপরীতে কর্তন করেনি উৎসে মূসক। শতভাগ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল অ্যাটায়ার লিমিটেডের বিরুদ্ধে কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের নিরীক্ষায় এসব অনিয়ম উঠে এসেছে। অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে অর্থদণ্ড দিয়ে বিচারাদেশ দিয়েছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ)। সম্প্রতি এই বিচারাদেশ দেয়া হয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, গ্লোবাল অ্যাটায়ার লিমিটেডের নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে কাস্টমস মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটকে চিঠি দেয় এনবিআর। সে অনুযায়ী কাস্টমস মূল্যায়ন নিরীক্ষা দল গঠন করে প্রতিষ্ঠানটির ২০১৭ সালের ১২ জুন থেকে ২০১৯ সালের ১১ জুন পর্যন্ত নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। পরে ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এনবিআরকে প্রতিবেদন দেয়া হয়। প্রতিবেদনে তিনটি অনিয়ম উঠে আসে, যার মধ্যে রয়েছেÑঅননুমোদিত এইচএস কোডে পণ্য আমদানি করে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা শুল্ককর ফাঁকি, বিপুল পরিমাণ কেমিক্যাল আমদানি করলেও তা সঠিক ব্যবহার না করায় প্রায় এক কোটি ২৮ লাখ টাকা শুল্ককর ফাঁকি, বিভিন্ন সেবা গ্রহণের বিপরীতে প্রায় চার কোটি ৪৬ লাখ টাকার উৎসে ভ্যাট ফাঁকি। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটকে নির্দেশ দেয় এনবিআর।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাভার আশুলিয়া মির্জানগর খেজুরটেক এলাকার বন্ডেড প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল অ্যাটায়ার লিমিটেড। শতভাগ সরাসরি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানটি শার্ট, প্যান্ট, জাকেট, ট্রাউজার, ক্যাপ ইত্যাদি তৈরি ও রপ্তানি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষা মেয়াদে অনুমোদনবিহীন অর্থাৎ বন্ড লাইসেন্সে অন্তর্ভুক্ত না থাকা সত্ত্বেও ৪২টি এইচএস কোড ব্যবহার করে কাঁচামাল আমদানি করেছে, যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ৬৭ কোটি ৫৯ লাখ ৭০ হাজার ৬২৪ টাকা, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ৫৬ কোটি ৩১ লাখ ৬ হাজার ১৫১ টাকা। কাস্টমস আইন ও বন্ড লাইসেন্স বিধিমালা অনুযায়ী, লাইসেন্সের শর্ত লঙ্ঘন করায় এই শুল্ককর ফাঁকি হয়েছে। যেহেতু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ জানত যে, আমদানি করা পণ্যগুলো তাদের বন্ড লাইসেন্সে অনুমোদিত নয়। জানা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ জালিয়াতি বা মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে পণ্যগুলো আইএম-৭ অর্থাৎ শুল্কমুক্তভাবে খালাসের জন্য বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেছে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কাস্টমস আইন ও বন্ড লাইসেন্স বিধিমালা লঙ্ঘন করে অননুমোদিত এইচএস কোডে এসব কাঁচামাল আমদানি করেছে। আরও বলা হয়, নিয়ম থাকলেও প্রতিষ্ঠান ডেডোর সহগ গ্রহণ করেনি। নিরীক্ষা মেয়াদে প্রতিষ্ঠান পোশাক ওয়াশিংয়ের জন্য কেমিক্যাল আমদানি করেছে। দুটি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানি করা এই কেমিক্যালের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য এক কোটি ৩১ লাখ ৭৮ হাজার ১৯২ টাকা, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর এক কোটি ২৮ লাখ ৬৬ হাজার ২৫৯ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এই কেমিক্যালের সঠিক ব্যবহার দেখাতে পারেনি। অপরদিকে নিরীক্ষা মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন (সিএ রিপোর্ট) অনুযায়ী, বিভিন্ন সেবা গ্রহণের বিপরীতে উৎসে কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। সুদসহ উৎসে করের পরিমাণ চার কোটি ৪৬ লাখ ৪ হাজার ১৯৯ টাকা।

অপরদিকে প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ও চলতি বছরের ৯ মার্চ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে প্রতিষ্ঠানের দেয়া কাগজপত্র, কাস্টমস মূল্যায়নের প্রতিবেদন ও অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই করে চলতি বছরের ২৭ মার্চ ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ) কমিশনার মোহাম্মদ আহসানুল হক পৃথক বিচারাদেশ দেন।

অননুমোদিত এইচএস কোডে কাঁচামাল আমদানির মাধ্যমে শুল্ককর ফাঁকির বিষয়ে দেয়া বিচারাদেশে বলা হয়, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি লিখিত জবাব প্রদান করে, যাতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের বায়ারের চাহিদা অনুযায়ী এইচএস কোড ব্যবহার করে কাঁচামাল আমদানি করে পোশাক তৈরি করে রপ্তানি করা হয়েছে এবং রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসিত হয়েছে। এরই মধ্যে এসব এইচএস কোড বন্ড লাইসেন্সে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা বন্ড কমিশনারেট পরে অনুমোদন দিয়েছে। সেজন্য এই অভিযোগ থেকে প্রতিষ্ঠান অব্যাহতি চেয়েছে। মামলার নথি, দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ ও প্রতিষ্ঠানের লিখিত জবাব পর্যালোচনা করে বলা হয়, যথাসময়ে কেন এসব অননুমোদিত এইচএস কোড বন্ড লাইসেন্সে কেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়নিÑশুনানিতে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কোনো সদুত্তোর দিতে পারেনি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি অননুমোদিত এসব এইচএস কোডে আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে পোশাক তৈরি করে যে তা রপ্তানি করেছে, তার সপক্ষে প্রতিষ্ঠান কোনো রপ্তানি দলিলাদি দাখিল করতে পারেনি। লাইসেন্সে এসব এইচএস কোড অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কাঁচামাল আমদানির পর, যা কাস্টমস আইন অনুযায়ী অপরাধ। নিরীক্ষাকালে এসব এইচএস কোডে লাইসেন্সে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এছাড়া বন্ড কমিশনারেটের অনুমোদন ছাড়াই এসব এইচএস কোডে কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, যা কাস্টমস আইন ও বন্ড লাইসেন্স বিধিমালার লঙ্ঘন। সেজন্য প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেয় কমিশনার।

অপরদিকে পোশাক ওয়াশিংয়ের জন্য আমদানি করা কাঁচামালের সঠিক ব্যবহার দেখাতে না পারায় দেয়া বিচারাদেশে বলা হয়েছে, লিখিত জবাবে প্রতিষ্ঠান জানায়, বন্ড সুবিধায় আমদানি ও স্থানীয়ভাবে এলসির মাধ্যমে ক্রয় করা কাঁচামাল কেমিক্যাল ব্যবহার করে পোশাক তৈরি করে তা রপ্তানিও করা হয়েছে। পরে কভিড-১৯ মহামারির কারণে আমরা কোনো কাঁচামাল আমদানি এবং ওয়াশিং কার্যক্রম করছে না। এছাড়া কোনো প্রকার কেমিক্যাল আমদানি ও স্থানীয়ভাবে ক্রয় করা হয় না। শুনানিতে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলেন, নিরীক্ষা মেয়াদে ডেডো কর্তৃক ইস্যুকৃত নিজস্ব সহগ গ্রহণ করেনি। সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের সহগ অনুযায়ী কাঁচামাল ব্যবহার করে রপ্তানি করা হয়েছে। কিন্তু নিজস্ব সহগ অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠান গার্মেন্ট পোশাক ওয়াশিংয়ের জন্য কাঁচামাল বা কেমিক্যাল সঠিক ব্যবহার দেখাতে না পারায় তার ওপর শুল্ককর ও মূসক প্রযোজ্য হবে। পর্যালোচনা শেষে বলা হয়, প্রতিষ্ঠান কেমিক্যালের সঠিক ব্যবহার দেখাতে পারেনি, যা কাস্টমস আইন ও বন্ড লাইসেন্স বিধিমালার লঙ্ঘন। সেজন্য প্রতিষ্ঠানকে ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। অর্থদণ্ড, মূসক ও শুল্ককরসহ মোট এক কোটি ৪৮ লাখ ৬৬ হাজার ২৫৯ টাকা প্রতিষ্ঠানকে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নান কা হাং কেলভিনের হোয়াসঅ্যাপ নম্বরে বক্তব্যের বিষয় লিখে দিলে তিনি সিন করেন। তবে কোনো জবাব দেননি। এর আগে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, পোশাক বা টেক্সাটাইলের কোনো পণ্য যদি রপ্তানি হয়ে যায়, তাহলে স্বঘোষিত, অঘোষিত, এসআরওসহ যা-ই থাকুক তা মাফ। যদি তার বিপরীতে দলিলাদি বা পিআরসি থাকে, সে সুবাধে এইচএস কোড বড় করে কেউ দেখে না। আমাদের বিষয় কেন দেখছে জানি না। এই অনিয়মের জন্য সামান্য জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হয়।