জালিয়াতি-ঋণে ডুবল এমারেল্ড অয়েল

পলাশ শরিফ: ঋণ জালিয়াতির মামলায় জামিন নিয়ে দেশ ছেড়েছেন উদ্যোক্তারা। এরপর মূলধন সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে উৎপাদন। কোম্পানির দুর্দিন দেখে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও চাকরি ছেড়েছেন। এসব কারণে শিগগিরই চালু হচ্ছে না উৎপাদন এমন চিত্র পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি এমারেল্ড অয়েলের। খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানিটি জালিয়াতির ঋণ ও মামলায় ডুবলেও সেই তথ্য বিনিয়োগকারীদের জানানো হয়নি। ডুবতে বসা কোম্পানি নিয়ে এখনও অন্ধকারে বিনিয়োগকারীরা।
তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে ২০১৬ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার জালে জড়িয়েছেন এমারেল্ড অয়েলের উদ্যোক্তারা। ওই বছরের শেষদিকে অর্থ আত্মসাতের মামলায় জামিন নিয়ে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ মনোয়ারুল ইসলাম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল গণি গালিব গা ঢাকা দিয়েছেন। এ কারণে ২০১৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর মালিকানা বদলে নতুন রূপে উৎপাদন চালুর চেষ্টাও করা হয়েছে, কিন্তু কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাই সহসাই উৎপাদন চালু হচ্ছে না। আর মূল্য সংবেদনশীল হলেও উৎপাদন বন্ধের তথ্য বিনিয়োগকারীদের জানানো হয়নি।
এদিকে ঋণ আর জালিয়াতির ভারে ডুবে যাওয়া এমারেল্ড অয়েল নিয়ে এখনও অন্ধকারে বিনিয়োগকারীরা। তাই কোম্পানিটির শেয়ারদর ফেসভ্যালুর নিচে নেমেছে। এমারেল্ড অয়েলের উৎপাদন সম্পর্কে ২০১৭ সালের এপ্রিলে সর্বশেষ ‘চলতি মূলধন সংকটের কারণে স্বল্প পরিসরে উৎপাদন চলছে’ বলে জানানো হয়েছে। এরপর কোম্পানিটির অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ২০১৭ সালের মার্চের পর কোম্পানিটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও চাকরি ছেড়েছেন।
ঋণ জালিয়াতির পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ব্যাংক ঋণের প্রকৃত তথ্যও এড়িয়ে যাচ্ছে এমারেল্ড অয়েল। ২০১৬ সালের পর কোনো নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি কোম্পানিটি। ওই বছরের জুন শেষে কোম্পানিটির বকেয়া স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৯৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। অথচ ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এমারেল্ড অয়েলের খেলাপি ঋণ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
উদ্যোক্তাদের অবর্তমানে কোম্পানিটির পরিচালক ও রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিব স্বজন কুমার বসাক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে এমারেল্ড অয়েলের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে তার সঙ্গে কয়েক দফায় যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয় বিজয়নগর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি কোম্পানিটির ওয়েবসাইটও এখন বন্ধ রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১১ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় প্রায় ৬০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল এমারেল্ড অয়েল। নতুন কৃষিভিত্তিক প্রকল্প, চলতি মূলধন জোগানো ও পরে আধুনিকায়নের জন্য (বিএমআরই) ঋণ হিসেবে ওই অর্থ নেয় এমারেল্ড অয়েল। তবে চালের কুঁড়া থেকে ‘স্পন্দন’ ব্র্যান্ডের ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী ওই কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করেনি বেসিক ব্যাংক। জামানত ঘাটতি রেখে ঋণ দেওয়া থেকে শুরু করে ডাউনপেমেন্ট ছাড়াই দফায় দফায় পুনঃতফশিল করা ও কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধির অভিযোগ রয়েছে। পরিশোধ না করায় এমারেল্ড অয়েলের নামে নেওয়া খেলাপি ঋণ ১২৪ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
অন্যদিকে এই উদ্যোক্তারা এমারেল্ড অটো ব্রিকসের নামেও বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। ওই ঋণও খেলাপি হয়েছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে যা ১২৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এমারেল্ডের দুই কোম্পানির পাশাপাশি আরও কয়েকটি কোম্পানির প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় এমারেল্ড অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল গণি গালিবের নাম এসেছে। দুদকের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করা হয়েছে। ২০১৬ সালের মার্চে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তিনি। পরে জামিন নিয়ে পরিবারসহ বিদেশে চলে গেছেন। প্রায় দুই বছরের বেশি তিনি বিদেশেই অবস্থান করছেন। একইভাবে কোম্পানটির চেয়ারম্যান সৈয়দ মনোয়ারুল ইসলামও দুদকের করা এমারেল্ড অটোব্রিকসের ঋণ জালিয়াতির মামলায় জড়িয়েছেন। তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে আসা এমারেল্ড অয়েলের পরিশোধিত মূলধন ৫৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর মোট প্রায় পাঁচ কোটি ৯৭ লাখ শেয়ারের মধ্যে ২৮ দশমিক ৪২ শতাংশ উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৯ দশমিক ২২ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৬২ দশমিক ৩৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ২০১৬ সালের জুন শেষে ১৮ কোটি সাত লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা দেখিয়েছে এমারেল্ড অয়েল। এর বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের ২০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছে।