জীবনমান উন্নয়নে ব্যবস্থা নিলে মূলধারায় ফিরবে বেদে সম্প্রদায়

মো. আশরাফুল ইসলাম: দেশের অতি পরিচিত প্রান্তিক যাযাবর গোষ্ঠী হলো বেদে সম্প্রদায়। তারা আমাদের দেশের অন্যতম সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী। নৌকায়ই তাদের জš§ আর নৌকায়ই তাদের ঘর-সংসার। বেদেদের ঘরবাড়ি, মাথার ওপর ছাদ ও সামাজিক মর্যাদা নেই। তাদের পাশে কেউ থাকে না, থাকে না প্রশাসনের সুনজর।

বৈদ্য থেকে ‘বেদে’ শব্দটির উদ্ভব। আরাকানের মনতং-মাণ্ডা নৃ-গোত্র থেকে বেদেরা এসেছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বেদেদের বাইদ্যা বা বাইদানি বলে ডাকে। কেউ কেউ তাদের জলের জিপসিও বলে থাকে। বেদেরা যাযাবর জীবন কাটায়। তারা জীবনের অধিকাংশ সময়ই নদীতে নৌকায় ভেসে বেড়ায়। জল, নদী ও নৌকা এ তিনটি তাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নৌকায় বহর নিয়ে তারা এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। নৌকার মধ্যেই চলে তাদের ঘর-সংসার। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবকিছুই নদীতেই হয়ে থাকে। ক্ষেতের ধান পাকা শুরু হলেই বিচিত্র রং আর বাহারি ঢঙের ছোট ছোট নৌকার বহর নিয়ে নোঙর ফেলে বেদে সম্প্রদায়। অনেকেই আবার রাস্তার ধারে ছোট ছোট ডেরা বেঁধে খুপরি ঘরে বসবাস করে থাকে। বেদে নৌকায় রাতের বেলায় চার্জার লাইট কিংবা সোলার বাতির আলো দূর থেকে দেখা যায়।

বেদেরা এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে এবং দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়। তারা পরিত্যক্ত খাসজমি, রাস্তার ধার, স্কুলের মাঠ কিংবা নদীর তীরে অতিথি পাখির মতো অস্থায়ী আবাস গড়ে। তারা এক জায়গায় বেশি দিন থাকে না। অজানা-অচেনা জায়গায় এসে নৌকা ভেড়ায়। আবার সে জায়গা থেকে উধাও হয়ে যায়। এভাবেই তাদের দিন, মাস ও বছর কেটে যায়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আমাদের দেশে বেদে সম্প্রদায়ের সংখ্যা আট লাখ। তাদের নিজস্ব কোনো ভূমি নেই। বেদে পরিবারের সদস্যদের কোনো ভূ-সম্পত্তি না থাকায় জন্ম ও মৃত্যু পানির ওপর নৌকাতেই হয়ে থাকে।

জনশ্রুতি আছে, বেদেরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বদরপুর এলাকা ও আসাম রাজ্যের কামরূপ জেলার কামাক্ষ্যা এলাকার আদিবাসী। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। তবে হাজার হাজার বছর ধরে এ দেশে বসবাস করায় তারা বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে নিয়েছে। কথিত আছে, ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শরণার্থী আরাকান রাজার সঙ্গে তারা ঢাকায় আসে। সে সময় তারা বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে। সেখান থেকে তারা বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। 

বেদেদের মাঝে অনেক উপ-সম্প্রদায় রয়েছে। মালবৈদ্য, বাজিকর, শালদর, সওদাগর ও গড়ালি তাদের মধ্যে অন্যতম। বেদেদের প্রধান পেশার মধ্যে চুড়ি-ফিতা-খেলনা বিক্রি, শিঙ্গা লাগানো, দাঁতের পোকা তোলা, তাবিজ-কবজ বিক্রি, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা, সাপের খেলা দেখানো, সাপের ব্যবসা করা, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, বানরের খেলা দেখানো, জাদু দেখানো, মাছ ধরা, পাখি শিকার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। একটা সময় সাপের গল্প নিয়ে প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম ব্যবসাসফল একটি ছবি। বেদেরা পশুপাখির হাড়গোড় দেখলেই ব্যাগে ভরে সংরক্ষণ করে রাখে। এসব হাড়গোড় তারা চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার করে থাকে। সাপ খেলা দেখানোর জন্য বেদেরা সাধারণত গোখরা ও অজগর সাপই বেশি পছন্দ করে। বেদেরা কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালন করে না। তবে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন অনেক দেব-দেবী, যেমন মনসা বা বিষহরির পূজা করে থাকে।

বেদেরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শ্রেণিবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। তারা ঢাকার সাভার, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরসরাই, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, চান্দিনা, এনায়েতগঞ্জ, ফেনীর সোনাগাজী ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করে। বেদেরা সাধারণত কার্তিক মাসের ৫ তারিখ থেকে অগ্রহায়ণ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে মুন্সীগঞ্জ কিংবা চট্টগ্রামে একত্রে মিলিত হয়। এ সময় তারা তাদের নেতা নির্বাচন করে থাকে। প্রতিদিন সকালবেলায় বেদেরা কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে আর দিন শেষে ঘরে ফিরে আসে। পুরুষেরা খুব সকালে পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সাহসী পুরুষেরা জঙ্গলে গিয়ে বড় বড় বিষধর সাপ ধরে নিয়ে আসে। পুরুষদের কেউ কেউ ডেরার কাছে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে থাকে। বেদেনিরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে নানা ধরনের রোগ-ব্যাধির ঘরোয়া চিকিৎসা করে থাকে। তারা দাঁতের পোকা খসায় এবং রস-বিষ খসায়। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অমিল থাকলে তাদের মেলবন্ধনের জন্য তাবিজ-কবজ দিয়ে থাকে। বেদেরা সব সময় সেজে থাকতে পছন্দ করে। বেদে নারীদের কাছে তার স্বামী অমূল্য সম্পদ। বেদে নারীরা স্বামীদের আঁচলে বেঁধে রাখতে চায়। বেদেরা স্বামীকে বশে রাখার জন্য সাপের চর্বি দিয়ে তেল মালিশ করে দেয়। তারা সব ধরনের বিপদ-আপদ, ঝক্কি-ঝামেলা থেকে তার স্বামীকে আগলে রাখতে চায়। বেদেদের প্রতিটি বহরের মধ্যে একজন করে সর্দার থাকে। বহরের অভ্যন্তরীণ যেকোনো ধরনের সমস্যা বহরের সর্দারই সমাধান করে থাকে। বেদেদের বহর ব্যবসা ও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এক জায়গায় এক সপ্তাহ থেকে এক মাসের বেশি থাকে না।

বেদে সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষই অশিক্ষিত। ভাসমান জীবনযাপনের ফলে তারা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তাছাড়া দারিদ্র্যও তাদের শিক্ষার সুযোগ গ্রহণের অন্যতম অন্তরায়। শিক্ষার আলো না থাকায় বাইরের জগৎ সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। কুসংস্কার ও উদাসীনতার কারণে তারা চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বেদেরা নদীর যে পানিতে প্রাকৃতিক কাজ সারে, সেই পানি আবার গোসল, রান্নাবান্না ও খাওয়ার কাজে ব্যবহার করে। ফলে তারা বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

দেশে ২০০৮ সালে বেদেদের প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার দেয়া হয়। যুগ যুগ ধরে তারা নাগরিক জীবনের অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বেদে সম্প্রদায়ের প্রায় ৯৮ শতাংশ সদস্য দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। বেদে সম্প্রদায়ের বিশুদ্ধ পানি কিংবা স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থার তীব্র সংকট। সাধারণ মানুষ বেদেদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার চোখে দেখে। তাদের সঙ্গে কেউ মিশতে চায় না। জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন সময় বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নের জন্য নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আর আশার আলো দেখে না।

বেদেদের জীবন দুঃখ-কষ্ট আর নানা সমস্যায় জর্জরিত। নাগরিক নানা অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। বেদে পরিবারের শিশুরা সব সময় পুষ্টিহীনতার শিকার হয়। তাদের চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের বেশিরভাগ প্রকৃতির লতাপাতা ও গাছগাছড়ার মাধ্যমে ওষুধ তৈরি করে রোগ নিরাময় করে থাকে।

উপার্জনের মৌসুম শেষ হলে বেদে পরিবারে বিয়ের আয়োজন করা হয়। বেদেদের বিয়েতে অ্যাপায়ন কিংবা উপহার প্রদানের কোনো নিয়ম নেই। বেদেদের মাঝে বাল্যবিয়ে ও বহুবিয়ের প্রচলন তেমন একটা দেখা যায় না। বেদে যুবক-যুবতীরা স্বেচ্ছায় পরস্পরকে পছন্দ করে বিয়েতে সম্মত হয়। বর-কনেসহ উপস্থিত সবাই নেচেগেয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। পছন্দের মেয়েটিকে এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায় তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়। বেদেদের বিয়ে ভেঙে দেয়ার নিয়মও বেশ সহজ। স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তাদের তালাক হয়ে যায়। বিয়েবিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটলেও বেদে মেয়েরা কখনোই ভেঙে পড়ে না। বর্তমানে বেদেদের বিয়ের রীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। কিছু কিছু বিয়ে বর্তমানে সরকারি খাতায় রেজিস্ট্রি হচ্ছে।

আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ বেদেদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ও পেশাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ফলে তাদের পুরোনো কবিরাজি ও তাবিজ-কবচ প্রথা মানুষকে তেমন একটা টানে না। মানুষ এখন আর সাপ খেলা, কিংবা জাদুবিদ্যায় তেমন আগ্রহী হয়ে ওঠে না। দিন দিন বেদেদের সাপ ধরা প্রথাও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বেদেনিদের শিঙ্গা এখন আর কেউ লাগায় না। কেউ দাঁতের পোকা ফেলে না। আগের মতো কেউ এখন আর চাল, ডাল ও শাকসবজির বিনিময়ে মাছ আনতে নদীর ঘাটে যায় না। বেদেরা নিরুপায় হয়ে নৌকা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করছে। তাদের টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।

পৃথিবীতে সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরোত্তর বিকাশ ও সমৃদ্ধি সাধিত হচ্ছে। কিন্তু বেদে সম্প্রদায়ের জীবনযাপনের আজও কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। তাদের জীবনে আসেনি সামাজিক মর্যাদা, কিংবা নাগরিক অধিকার পাওয়ার তৃপ্তি। এমনকি শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো অত্যাবশীয় অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। আধুনিক সমাজ তাদের মানুষ হিসেবেও স্বীকৃতি দিচ্ছে না। তাদের নিয়ে ভাবার কিংবা তাদের নিয়ে কথা বলার জন্য কেউ এগিয়েও আসছে না। সমাজের একটি অংশকে বাদ দিয়ে একটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি কখনোই সম্ভব নয়। বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বেদেরা হারিয়ে গেলে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির একটি অংশ চিরতরে হারিয়ে যাবে।

শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়