মো. তৌহিদুজ্জামান বাবু: বর্তমান সময়ে মানুষের পরিচয় নির্ধারিত হয় ব্যক্তির উপার্জন দিয়ে। নৈতিকতার সবচেয়ে বড় মানদণ্ড হলো সমাজের আর দশজন কী করছে, সেটা না করতে পারলে মানুষ কী বলবে? আমি তো সমাজের চোখে হীন হয়ে যাব!
সেই জন্মের পর থেকে এভাবেই আমরা জীবনকে দেখতে শিখি, মাপতে শিখি, স্বপ্ন দেখি এবং এভাবেই আমরা সাফল্য খুঁজি। চাকার ভেতরে আটকে পড়া ইঁদুরের মতো ক্রমাগত ছুটে চলি মরীচিকার পেছনে। আর নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে টেনে দিই ধরাবাধা এক কাজের রুটিন। প্রতিটি দিন শুরু করি ঠিক যেন সেই আগের জায়গা থেকে! আমরা তখন কাজ ও জীবনকে করে ফেলি একীভূত।
কাজ আর জীবনÑএই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়? করাটা কঠিনই বলা চলে। বেশিরভাগ মানুষই ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে পারে না। কেউ কাজকে সময়? দিতে গিয়ে জীবনের দিকে তাকাতে পারে না।
আবার কেউ জীবনকে উপভোগ করতে গিয়ে কাজকে সময় দিতে পারে না। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য দুটোই প্রয়োজন।
মানুষের জীবনেও কর্মজীবন আগে না ব্যক্তিগত জীবন আগেÑএ নিয়ে রয়েছে সংশয়। আবার অনেকেই সারাজীবন কেবল চিন্তাই করেন, কীভাবে তিনি ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স করে জীবনটাকে উপভোগ করবেন। যখন কাজে ব্যস্ত হয়ে যান তখন নিজেকে আর সময় দেয়া হয় না, আবার সময় অপচয় করার মতো সময়ও কিন্তু কম নেই। এভাবে চলছে মানুষের জীবন। প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যস্ততার সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনে কর্মজীবনের ব্যালান্সটা রক্ষা করা খুবই জরুরি। ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স রক্ষা করার অর্থ হচ্ছে সারাদিনের কতটুকু সময় কাজ, আর কতটুকু ব্যক্তিগত জীবনে ব্যয় করা উচিত তার একটি হিসাব।
ব্যক্তি যাতে নিজেকে যথেষ্ট সময় দিতে পারে আবার ঠিক তার পাশাপাশি কর্মজীবনও যেন তাৎপর্যপূর্ণ হয়। এই পুরো সময়জুড়ে হীনমন্যতা, চাপ ও প্রতিকূল পরিবেশকে মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার নামই হচ্ছে ভারসাম্য। নিজের ওপর অবিচল বিশ্বাস নিয়ে সামনের দিকে পথ চলতে পারলেই সফলতার দেখা পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে সাফল্য ধরে রেখে সুন্দর একটি জীবনযাপন করা সম্ভব হয়।
কাজ ছাড়া জীবন কেবল জীবনের ফ্যাকাসে সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই কাজ আর জীবনের ভারসাম্য রক্ষার কিছু উপায়ও বের করে নিতে হবে কৌশলে। যেমনÑ
কী কী কাজ করতে হবে তার একটি তালিকা তৈরি করা : জীবনে প্রতিনিযত অসংখ্য কাজ করতে হয়। তাই জীবন ও কাজের মধ্যে ভারসাম্য আনার প্রথম উপায় হতে পারেÑ যে কাজগুলো করতে হবে তার একটি তালিকা তৈরি করা। তালিকাটি হতে পারে দৈনিক, সাপ্তাহিক অথবা মাসিক। তবে এ তালিকায় কাজের স্তর হবে দুটিÑএকদিকে থাকবে অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলো। যেমন বাড়ি?র কাজ, ছাত্রদের জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া, ক্লাসের পড়?া সম্পন্ন করে ক্লাসে যাওয়া, চাকরিজীবীদের জন্য অফিস আওয়?ারে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা, প্রজেক্ট কিংবা প্রেজেন্টেশন তৈরি করা ইত্যাদি। অন্যদিকে থাকবে যে সকল কাজ করতে বেশি ইচ্ছে হয় সেগুলো। যেমন কোথাও ঘুরতে যাওয়া, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, মুভি দেখা, খেলাধুলা করা, বাগান করা কিংবা অবসরের পুরো সময়?টা প্রিয় মানুষদের সঙ্গে উপভোগ করা ইত্যাদি।
কাজের সময় এবং উপভোগের সময় আগেই নির্দিষ্ট করে রাখা : আমাদের একটা বড়? সমস্যা হলো কাজ এবং উপভোগের সময় নির্দিষ্ট করে না রেখে জগাখিচড়ি পাকিয়ে ফেলি। ফলে হুট করে দেখি হাতে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে কিন্তু সেগুলো সম্পন্ন করার জন্য সময় থাকে নিতান্তই অনেক কম। কাজ এবং উপভোগের সময়? নির্ধারিত করার মাধ্যমে অর্থাৎ কাজ না জমিয়ে রেখে প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিনই করে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ, যা জীবনে এনে দিতে পারে ভারসাম্য।
সমন্বয় করে কাজ করা: দৈনন্দিন জীবনে ছোট ছোট অনেক কাজ থাকে, যেগুলো আলাদাভাবে করতে গেলে অনেক সময় এবং শ্রম লাগে। অথচ সামান্য বুদ্ধি খাটিয়ে সেই কাজগুলো সমন্বয়? করে করলে সময় ও শ্রম দুটোই সাশ্রয় হয়। যেমন কাপড় ইস্ত্রি করার জন্য একবার বাইরে যাওয়?া এবং সবজি কেনার জন্য আরেকবার বাজারে না গিয়ে বরং বাজারে যাওয়ার পথেই কাপড় ইস্ত্রি করতে দিলে সময়? অবশ্যই বেঁচে যাবে। এভাবেই কিছু কিছু কাজ কৌশলে একসঙ্গে করলে আমাদের জীবনের চাপ কমবে এবং জীবনে ভারসাম্য আনতে সহায়?ক ভূমিকা পালন করবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অযথা সময়? অপচয়? না করা: কারণে-অকারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রয়ে?াজনে অনেক বেশি সময় নষ্ট করে ফেলেন। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের কিছু অংশ অপচয় বা নষ্ট হয়ে যায়, যা পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত মানসিক চাপের সৃষ্টি করতে পারে। তাই সামাজিক মাধ্যমে নিজের ওপর নিয়?ন্ত্রণ আনার মাধ্যমেও ভারসাম্য রক্ষা করা যেতে পারে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা: যেভাবেই পরিকল্পনা করা হোক না কেন, সবসময়ই চেষ্টা করতে তা যথাযথভাবে মেনে চলতে। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে আর সে অনুযায়ী কাজ করতে সমস্যাই হবে না। তখন জীবন হয়ে উঠবে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল।
পরিবারকে সময় দেয়া : পরিবার মানেই সবচেয়ে কাছের মানুষগুলো। তবে এই প্রিয় মানুষগুলোকে সময় দেয়াটাও যে জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা অনেকেই মানি না। অথচ জীবনটা যে শুধু কাজ দিয়ে?ই সীমাবদ্ধ নয়, এর বাইরেও যে অনেক কিছু আছে, সেটাকে কেবল পরিবারের সঙ্গে মিশে থাকলেই বোঝা যায়?। কেননা পরিবারের বড়দের পরামর্শগুলোই বদলে দিতে পারে প্রত্যেকের জীবন ধারা এবং এনে দিতে পারে উপযুক্ত ভারসাম্য।
কাজ এবং জীবনের মধ্যে যখন ভারসাম্য বজায়? থাকে, তখনই আমরা সতেজ থাকি, ভালো থাকে মন এবং তখনই মানুষ সুখী জীবনযাপন করতে পারে। সারাক্ষণ কাজ করার জন্যই জীবন নয় বরং জীবনে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য ভারসাম্য রেখে কাজ করা প্রয়োজন।
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়