জীবনের সর্বস্তরে দুর্নীতিকে না বলুন

মো. আরাফাত রহমান:‘দুর্নীতি’ শব্দ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। সামাজিক জীবনে প্রতিদিনই আমরা কোনো না কোনো দুর্নীতির খবর জানছি, শুনছি ও পড়ছি। এমন কোনো স্থান নেই যেখানে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করেনি। আমাদের পারিবারিক জীবন এমনকি ব্যক্তিজীবনে পর্যন্ত দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে মারাত্মকভাবে। এই দুর্নীতি রয়েছে সর্বত্র। ঋণ নিয়ে হজম করে ফেলা, সরকারি সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করা, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ করা, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস চুরি, চাকরির নামে প্রতারণা ও হয়রানি করাÑদুর্নীতি কোথায় নেই? এমনকি দুস্থ মানুষদের গম নিয়ে ও এতিমদের বস্ত্র নিয়েও দুর্নীতি হচ্ছে। পরীক্ষার আগে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রি, অতঃপর পরীক্ষার হলেও দুর্নীতি আধিপত্য বিস্তার করেছে। মেধা তালিকায় স্থান নির্ধারণেও চলে দুর্নীতি।

দুর্নীতি ধর্মতাত্ত্বিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আদর্শের বিচ্যুতিকে নির্দেশ করে। বৃহৎ পরিসরে ঘুষ প্রদান, সম্পত্তি আত্মসাৎ এবং সরকারি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করাও দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত। দুর্নীতি শব্দটি যখন বিশেষণ হিসেবে ব্যবহƒত হয়, তখন সাংস্কৃতিক অর্থে সমূলে বিনষ্ট হওয়াকে নির্দেশ করে। দুর্নীতি শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন এরিস্টটল। অর্থনীতিবিদরা একে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘দুর্নীতি এমন একটি কাজ যেখানে অনৈতিক অর্থ প্রদানের কারণে তৃতীয় কোনো পক্ষ সুবিধা পায়, যার ফলে তারা বিশেষ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করে। এতে করে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত পক্ষটি এবং তৃতীয় পক্ষ উভয়ই লাভবান হয় এবং এই কাজে দুর্নীতিগ্রস্ত পক্ষটি থাকে কর্তৃপক্ষ।’

দুর্নীতির সর্বনাশী সামাজিক ব্যাধির মারণ ছোবলে বর্তমান সমাজ জর্জরিত। দুর্নীতি শব্দটির অর্থ হলো নীতিবিরুদ্ধ, কুনীতি, বা অসদাচরণ। স্বাভাবিকভাবে যা নীতি-সমর্থিত নয়, তাকেই আমরা দুর্নীতি বলি। মানুষ যখন স্বেচ্ছাচারিতার প্রকাশ ঘটিয়ে অন্যায়ভাবে নীতিকে লঙ্ঘন করে কোনো কাজ করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করে, তা-ই দুর্নীতি। বস্তুত দুর্নীতি একটি ব্যাপক ও জটিল প্রত্যয়। দুর্নীতি সমাজের প্রচলিত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থি বিশেষ ধরনের অপরাধমূলক আচরণ। দুর্নীতির সঙ্গে পেশা, ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা, পদবি প্রভৃতি অপব্যবহার সংশ্লিষ্ট।

রাজনীতি ও অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়ে থাকে। দুর্নীতি প্রতিরোধের মাধ্যমে এই বিপুল অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হলে তা দিয়ে শিশু ও প্রসূতির চিকিৎসা, আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মেরামত ও জনকল্যাণে ব্যয়ের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে দেশটা যেমন অনেক দূর এগিয়ে যেত, তেমনি দাতাদের ওপর আমাদের নিভর্রশীলতাও অনেকটা কমে আসত। জাতীয় জীবনের গভীরে প্রোথিত এমন জাতীয় সমস্যার সমাধানের সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনাও নেই। তবে সবাই এ কথা স্বীকার করেছেন যে, জাতীয় জীবনীশক্তি বিনাশকারী এই ভয়াবহ মহামারি থেকে জাতিকে রক্ষা পেতে হলে সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন।

দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার এবং এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ অন্যান্য ক্ষতির বিশালতার কারণে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা দুর্নীতিকে বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন পিছিয়ে পড়ছে এও নতুন কথা নয়। তবু দুর্নীতি কমছে না। দিন যতই যাচ্ছে দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তত বেশি প্রবেশ করছে। সমাজে সৃষ্টি করছে চরম অস্থিতিশীলতা। দুর্নীতির কারণে সামাজিক ভারসাম্য নষ্টের ফলে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী দুষ্ট ক্ষতের।

ঘুষের কথা তো আছেই। ঘুষ প্রদান ছাড়া ফাইল নড়ে না। উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলেন, একসময় ঘুষের প্রতি এতই অনীহা ছিল যে, যে চাকরিতে ঘুষের সুযোগ থাকত, সামাজিকভাবে ওই ধরনের চাকরিতে কর্মরতদের সঙ্গে সামাজিক বন্ধনেও অনীহা ছিল। এখন অনীহার বদলে দেখা যায় উপরি আয়ের কথা চিন্তা করেই আত্মীয়তার ক্ষেত্রে অনেকেই এগুচ্ছে। নৈতিকতার প্রতি মানুষের আন্তরিকতা যেন আর থাকছে না। সমাজে এ ধরনের নৈতিক স্খলনের ফলে সংজ্ঞাভেদে বাংলাদেশে এখন ঘুষের লেনদেন হয় প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংক একটি স্মারক প্রতিবেদনে বলেছে, দেশে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে মোট লেনদেনের সাত শতাংশ ঘুষ দিতে হয়।

দুর্নীতি বিভিন্ন মানদণ্ডে ঘটতে পারে। আওতা বা বিস্তৃতি ছোট হলে এবং তাতে যদি অল্পসংখ্যক মানুষ জড়িত থাকে, তবে তাকে ক্ষুদ্রার্থে আর যদি বড় আকারে প্রভাবিত হয়ে পড়ে, তবে ব্যাপকার্থে দুর্নীতি হিসেবে নির্দেশিত হয়। ক্ষুদ্র দুর্নীতি ছোট মাত্রায় এবং প্রতিষ্ঠিত সামাজিক অবকাঠামো ও প্রশাসনিক নিয়মের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। অনুগ্রহ বা অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে এই প্রকারের দুর্নীতিতে ক্ষুদ্র উপহার বা ব্যক্তিগত সংযোগকে ব্যবহার করা হয়। মূলত উন্নয়নশীল বিশ্বে এই প্রকারের দুর্নীতি বেশি, কর্মচারী-কর্মকর্তাদের তুলনামূলক নি¤œপর্যায়ের বেতন-ভাতা প্রদান যার একটি বিশেষ কারণ।

দুর্নীতি আরও বিভিন্নভাবে দেশ ও জনগণের উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। যেমন প্রশাসনিক দক্ষতা হ্রাস করে, জনগণের বিড়ম্বনা বৃদ্ধি করে, সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করে, জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করে, মূলধন গঠন ও উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করে, সামাজিক নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও সন্ত্রাস বৃদ্ধি করে। আমাদের দেশে দুর্নীতিবিষয়ক যেসব আইন রয়েছে, তার মধ্যে ‘দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭’ এবং ‘দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৫৭’ উল্লেখযোগ্য।

‘দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭’ অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাতে ঘুষ ও দুর্নীতিতে জড়িত হতে না পারে, তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই আইনটি করা হয়। এই আইনের আওতায় কেউ এ-জাতীয় অপরাধ করলে সাত বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড কিংবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। ‘দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৫৭’ অনুযায়ী বিধান রয়েছে যে, সরকার যদি তথ্য প্রাপ্তির পর অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হয়, কোনো ব্যক্তি বা তার নিজস্ব কোনো প্রতিনিধির নিকট এমন পরিমাণ অর্থ কিংবা সম্পদ রয়েছে, যা ওই ব্যক্তির জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের জন্য ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৩’ গঠিত হয়।

২০১৭ সালে ‘আসুন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হই’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস ৯ ডিসেম্বর পালনের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়। জাতিসংঘ ২০০৩ সালের ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। দুর্নীতি দমন কমিশন ২০০৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন শুরু করে। দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতি বছর দিবসটি পালন করলেও দেশে সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হতো না। এ প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি দমন কমিশন ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালনের অনুরোধ জানিয়ে ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে পত্র পাঠায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই সরকার ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস’ ঘোষণা করে।

সরকার সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। অবৈধ লেনদেন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও ক্ষমতা অপব্যবহারে জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছে অনেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী। বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরে চালানো হচ্ছে শুদ্ধি অভিযান। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি কার্যকর ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়া হয়েছে। দেশব্যাপী যৌথবাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা মাঠপর্যায়ে কাজ করে জঙ্গি তৎপরতা, বিচ্ছিন্ন সংঘাত-সংঘর্ষ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই ইত্যাদি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ধরনের পদক্ষেপ অব্যাহত থাকলে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

জনগণের পক্ষ থেকে সহযোগিতা না পেলে একা সরকারের পক্ষে এর সমাধান করা সম্ভব নয়। অতএব এই আন্দোলনে সরকার ও সুশীল সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস অপরিহার্য। এজন্য আমাদের যা যা করতে হবে তা হলোÑবিচার বিভাগের সক্রিয় ভূমিকা থাকতে হবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের সক্রিয় ভূমিকা থাকতে হবে, জনগণের সমর্থনের ওপর সরকারের ক্ষমতায় আসা নির্ভর করে বলে সরকারকে আইনের শাসন নিশ্চিত করার মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে, মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে, ধর্মীয় বিশ্বাসকে উজ্জীবিত করতে হবে। এছাড়া মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত করতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপে দেখা যায়, দুর্নীতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এই হিসাবটি করা হয় ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে। যে দেশ যত দুর্নীতিমুক্ত, সে দেশের পয়েন্ট তত বেশি। রাষ্ট্র ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগে আকাশচুম্বী সমস্যারও সহজ ও দ্রুত সমাধান সম্ভব। বিশ্বায়নের এই তীব্র প্রতিযোগিতার যুগে আমরা দুর্নীতির কারণে এভাবে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারি না। আমাদের রয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও জাতিকে উজ্জীবিত করার শক্তিশালী আদর্শ। শুধু প্রয়োজন সুচিন্তিত ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ। ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার ও ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হোক আমাদের হাজার মাইল পদযাত্রার পথম পদক্ষেপ।

সহকারী কর্মকর্তা

ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট

সার্ভিসেস বিভাগ

সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়