সিপিডি আলোচনা সভায় বক্তারা

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে

নিজস্ব প্রতিবেদক: বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষের ওপর এক ধরনের বাড়তি মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তারা বলছে, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে যাতায়াত ব্যবস্থার খরচ বেড়ে যাবে। বাসভাড়া, ট্রাক ও লঞ্চভাড়া বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে ভাড়া বেড়ে গেছে। সরকার ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। এক্ষেত্রে তারা তেলের দাম পুনঃবিবেচনাসহ সরকারকে তিনটি সুপারিশ দিয়েছে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) কার্যালয়ে ‘জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এখন এড়ানো যেত কি?’ শীর্ষক আলোচনায় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এসব বিষয় তুলে ধরেন।

সিপিডির সুপারিশগুলো হলো জ্বালানি তেলের দাম পুনঃবিবেচনা করা- বিশেষত দাম কমিয়ে সবন্বয় করা ও এম এস ট্রাকের করে খোলা বাজারে পণ্য বিক্রি বাড়ানো, বেশনিং কার্ডের মাধ্যমে নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে কম মূল্যে পণ্য বিতরণ এবং মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যেক্তাদের মাঝে ঋণ বিতরণ। 

মূল প্রবন্ধে ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকার চলতি বছরে তেল বিক্রি করে ১ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা লাভ করলেও ৮ হাজার ১৫ কোটি টাকা লোকসানের কথা বলছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে (বিপিসি)। এছাড়া ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি। অন্যদিকে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সারা বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম কমছে অথচ আমাদের দেশে বৃদ্ধি করা হলো। কেউ বলছে আমাদের দেশ থেকে নাকি অন্য দেশে কম। কিন্তু নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া কোথাও তেলের দাম বাড়তি নেই। এই বাড়তি তেলের দাম নতুন করে মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে। তিনি আরও বলেন, আমরা ভর্তুকির পক্ষে নই। তবে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা খুবই ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে সামনের দিকে। সরকার চাইলে পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে তেলের দাম বাড়াতে পারত। এ সময় তিনি জ্বালানি তেলের দাম পুনঃবিবেচনার দাবি জানান। 

সিডিপির নির্বাহী পরিচালক ভিয়েতনামের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ভিয়েতনাম উদীয়মান অর্থনীতির একটা দেশ অথচ দেখেন ভিয়েতনামে ডিজেলের লিটারপ্রতি দাম ৯৭.৯ টাকা। আমরা কার সঙ্গে কী তুলনা করছি? আমরা বলছি হংকংয়ে নাকি জ্বালানি তেলের দাম আরও বেশি। এটা ঠিক আছে। কিন্তু হংকং এ মাথাপিছু আয় ৪৯ হাজার ৬৬০ ডলার। আমাদের ২ হাজার ৫০৩ ডলার। সুতরাং কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করতে হলে মাথাপিছু আয়ও দেখতে হবে।

সরকার জ্বালানি তেলের দাম এত বাড়ানোর সাহস পেল কীভাবে?: এ সময় আলোচনায় অংশ নিয়ে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক, জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমরা কেউ ভর্তুকি পছন্দ করি না। কিন্তু হঠাৎ জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম চাপিয়ে দেয়া হলো। আমরা এটা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছি। সরকার এত সাহস করল কীভাবে? জ্বালানি তেলকে রাজস্ব আয়ের জন্য সরকার ব্যবহার করছে। পরোক্ষভাবে রাজস্ব নিতেই মূলত জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, হঠাৎ করে কেন এটা করা হলো? এর ফলে পরিবহন ও কৃষিতে অনেক ক্ষতি হবে। উন্নয়নশীল দেশে ডিজেলে ভর্তুকি দিয়ে থাকে একটা স্বীকৃত বিষয়। যখন উন্নত দেশ ফুয়েলের দাম কমাচ্ছে। যথচ সরকার এমন একটা সময় দাম বাড়িয়ে দিলো, যখন আমরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। বিশ্বে তেল থেকে রাজস্ব আয়ের টেনডেনসি আছে। তবে ডিজেলের দাম সব দেশেই কম রাখে। ডিজেলের ভর্তুকি না দিলে অনেক রকম ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে খারাপ সময়ে আছি। তেলের দাম বৃদ্ধিতে সবাই বিপদে পড়েছে।

অনেক শ্রমিক গ্রামে যাওয়ার আশঙ্কা: বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেছেন, আমরা এমনিতেই নানা সমস্যায় আছি। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাবে। অনেক শ্রমিক খরচ মেটাতে পারবে না, তারা গ্রামে চলে যাবে। এতে আমাদের শিল্প বন্ধ হবে। ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিক বিপদে পড়বে। তিনি আরও বলেন, এখন লোডশেডিং হচ্ছে, তাছাড়া ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ডিজেল দিয়ে শিল্প চালু রাখা সম্ভব না। আমরা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি। কারণ বায়ারের কাছ থেকে বাড়তি দাম নিতে পারছি না।

বিপিসির ক্ষতির হিসাব জানানো উচিত: সিডিপির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিপিসি ত্রুটিপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের ওপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। গত ৬ বছরে বিপিসি ৪৬ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। যেখান থেকে সরকার নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায় বলা হয়েছে, ওই টাকার মধ্যে ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু সেই হিসাব খুঁজে পাই না। আমি মনে করি বিপিসির হিসাব জনগণকে জানানো উচিত। 

তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি বিভিন্ন ব্যাংকে বিপিসির ২৫ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা জমা রয়েছে। তাহলে ওই টাকা কোন টাকা? এছাড়া বাকি টাকা কোথায়? আমার ধারণা বাকি টাকাও বিপিসির হিসাবেই রয়েছে। তাহলে কেন লোকসান দেখিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হলো? গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি না করে অব্যবহƒত অর্থ দিয়ে চলমান সমস্যার সমাধান করা যেত। আইএমএফের পরামর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় ওই কৌশল নেয়া যেত। ভোক্তার ওপর দায় চাপানো ঠিক হয়নি।

অফিসগামী যাত্রীদের ভাড়া বেড়েছে: অলোচনায় অংশ নিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমরা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে দেখেছি অফিসগামী গণপরিবহনের যাত্রীদের ভাড়া দৈনিক বেড়েছে ৭০ থেকে ২০০ টাকা করে। মাসে তা দুই হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত। তিনি বলেন, যারা কর্মজীবী-শ্রমজীবী আছেন, তাদের প্রায় ৮০ শতাংশের বেতনে যাতায়াত ভাড়া দেয়া হয় না। আমরা দুদিনে ২৮টি বাস কাউন্টারে পর্যবেক্ষণ করে এ তথ্য উপাত্ত আপনাদের দিচ্ছি।