বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত বিনোদনের মধ্যে টিকটক ভিডিও প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। এর ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। ২০১৬ সালের শেষের দিকে চীন দেশে এই অদ্ভুত মিডিয়ায় উদ্ভব হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা চীনের নাগরিক ঝাং ইয়েমিং। উৎপত্তি চীনে হলেও এটি বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অ্যাপ্লিকেশন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাইরের আলোচনা বাদ দিয়ে শুধু বাংলাদেশের আলোচনা করতে বসলে পুরো মহাভারত রচনা হয়ে যাবে।
বর্তমানে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবাই এই বিষাক্ত টিকটকের জালে আটকে আছে। একে জাল না বলে বিষাক্ত ভাইরাস বলাই যথার্থ। ভাইরাস যেমন এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। তেমনি এই টিকটক মিডিয়াও মুহূর্তে জনে জনে ছড়িয়ে গেছে; দুধের শিশু থেকে শুরু করে ৮০ থেকে ১০০ বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও বাদ যায় না। সব বয়সের ও প্রজšে§র গায়ে লেগে আছে এই ছোঁয়াচে ভাইরাস। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, হাসপাতাল ও রাস্তাঘাটে এমনকি কবরস্থানে গিয়েও টিকটক ভিডিওর দৃশ্য দেখা যায়। আবার দেখা যায়, রাস্তায় পথ আটকে, গাড়ি আটকে, এমনকি পথচারী মেরেও আহত করছে টিকটকাররা। কয়েক বছর আগে ‘অপু ভাই’ নামের চুলের ফ্লুরোসেন্ট সবুজাভ ধাঁচের রং করা এক তরুণের ছবি খবরে বেশ দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাকে নিয়ে বেশ আলাপ চলেছিল। অপু ভাই নামের এই টিকটকার অবশ্য তার ভাইরাল ভিডিওর জন্য খবরের কাগজে আসেনি। এসেছিল রাস্তায় মারপিট করে গ্রেপ্তার হওয়ার পর।
তিন থেকে ৬০ সেকেন্ড পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ছোট ভিডিও তৈরি করে তা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। প্রথম দিকে যখন টিকটক মিডিয়ার আবিষ্কার হয়, প্রথম সভ্য সমাজই তার ব্যবহার করত। কিন্তু ট্রেন্ডটার ১২টা বাজাতে অসভ্য সমাজের আগমন হতে খুব বেশি সময় লাগে না। নাটক, সিনেমা ও গানের সেলিব্রিটিদের মতো টিকটক সেলিব্রিটিও আছে। উদ্ভট তাদের আচার-আচরণ কিংবা সাজগোজ। দিন দিন তাদের সাজপোশাকের মাত্রা আচার-আচরণ নিম্ন থেকে নিম্নতর পর্যায়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও শরীর প্রদর্শনের বড় মাধ্যম টিকটক ভিডিও। কয়েক সেকেন্ডের এই ভিডিওতে প্রতিযোগিতায় লেগে যায় কে কত বেশি নিজেকে আর্কষণীয়ভাবে তুলে ধরতে পারে, কতটা নির্লজ্জভাবে নিজেকে হাইলাইট করতে পারে অন্যের কাছে। লাইক, শেয়ার, কমেন্ট, ফলোয়ার, ভিউ ও সাবসক্রাইবের জন্য নিজের শরীরের ভাঁজ দেখানোর মতো এমন নিচুতা ও হীনতা বোধহয় হয় না আর! পোশাকের উদ্ভট কারুকাজ ও চেহারার কৃত্রিমতা সব মিলিয়ে তাদের মানসিক বিকারগ্রস্ত ছাড়া কিছুই বলা যায় না।
শুরুতে টিকটক ভিডিও টোকাই, অক্ষরজ্ঞানহীন ও বেকার ছেলেমেয়ে হলেও বর্তমানে তা স্কুল-কলেজ এমনকি ভার্সিটির গণ্ডিও পেরিয়ে গেছে। এখন শিক্ষিত যুবক-যুবতীর মধ্যে এর হার সবচেয়ে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবক-যুবতীরা এখন এই মিডিয়ার সবচেয়ে বড় সেলিব্রিটি। মেয়েরা শরীরের ভাঁজ দেখাতেই যেন বড্ড আনন্দ পায়। অন্যকে শরীর দেখিয়ে আনন্দ পাওয়া, উদ্ভট আচরণ করে অন্যের মনোযোগ আর্কষণ করা, নিজেকে দামি ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই যে নিজেকে তারা কতটা মূল্যহীন, কীট ও বাজারের পণ্য বানিয়েছে, তা তাদের ধারণার বাইরে।
শুধু উদ্ভট আচরণ ও সাজপোশাকেই এসব কার্যকলাপ আজকাল সীমাবদ্ধ নয়। আজকাল টিকটক মিডিয়ার বদৌলতে শত শত ক্রাইম হচ্ছে। কয়েক মাস আগে ‘বুঝো নাই ব্যাপারটা’র টিকটক আইডির মালিক আতিক তার নিজ এলাকা কুমিল্লায় একটা স্কুলের মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার ভিডিও নিজ আইডিতে শেয়ার করে। ভিডিওতে দেখা যায়, আতিক অকথ্য ভাষায় ওই মেয়েকে গালাগাল দিতে থাকে। অবশেষে মেয়েটি পুলিশের শরণাপন্ন হলে আতিক বলে, আমি শুধু জাস্ট মজা করার জন্য ভিডিও করেছি। আবার ‘অপু ভাই’ নামে এক ছেলেকে রাস্তায় মারপিট করা অবস্থায় পুলিশ ধরেছে। টিকটক করার সময় রাস্তায় পথচারীদের গায়ে হাত তোলে সে। আদালতে বিচারক অপুর চুলের কালারের কথা জিজ্ঞেস করে বলেন, তোমার চুলের কালার এমন কেন? অপুর পক্ষের উকিল বলে, অভিনয় করতে এমনটা করা লাগে। তখন বিচারক বলেন, অভিনয় জগতের এমন খারাপ অবস্থা হয়েছে, তা জানা ছিল না আমার।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব এবং বেশকিছু টিকটক ও লাইকি ভিডিওতে যা দেখা যায়, তা রুচির অযোগ্য এবং ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বিকৃত অঙ্গভঙ্গি এবং অশ্লীল শব্দ ও যৌনতা প্রয়োগ করে শুধু সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার উদ্দেশ্যে এই ভিডিওগুলো তৈরি করে আপলোড করা হচ্ছে, যারা নির্মাতা তাদের ৮০ শতাংশ হলো কিশোর-কিশোরী। এখন আবার ফ্যামিলি টিকটক ভিডিওও দেখা যায়। বাবা-মেয়ে, মা-ছেলে, স্বামী-স্ত্রী এমনকি দুধের বাচ্চাকেও এ বেহায়াপনাপূর্ণ কাজের অংশীদার করা হচ্ছে। শুধু সস্তা জনপ্রিয়তার জন্যই নীতি-নৈতিকতার খোলস ছেড়ে বেপরোয়া নাচগান তৈরি করা হয় এসব ভিডিওতে। সমাজের প্রতিটি গোড়ায় জেঁকে বসে আছে এ বিষাক্ত জাল। ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ মিডিয়ার ভয়াবহতা দেখতে পাই। এমনকি বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিলের কাটিং ভিডিও করে নিজেদের মুখ মিলিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে বেহায়াপনাপূর্ণ পোশাকে ভিডিও বানানো হচ্ছে।
এই বিষাক্ত জাল থেকে মুক্তি কীসে? কীভাবে আমরা আমাদের পরিবার ও সমাজ থেকে এ বিষাক্ত বিষফোঁড়া উপড়াতে পারব? পারিবারিক সচেতনতা ও বাবা-মায়ের সতর্কতাই এর একমাত্র সমাধান হতে পারে। বাব-মা যদি অন্যের বাচ্চাদের মতো অনুকরণ করে নিজের বাচ্চাকে ভিডিও গেমস ও মোবাইল ফোন হাতে না দেয় তাহলে এ জাল থেকে অনেকটা রেহাই মিলবে। সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, হালাল-হারাম, গ্রহণীয়-বর্জনীয় প্রভৃতির পার্থক্য বোঝাতে হবে। এই সোশ্যাল জাল ও বিষাক্ত নেটওয়ার্ক বন্ধ করা কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রশাসনিক সহযোগিতায় তা নির্মূল করা উচিত। এই টিকটক ভিডিও নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। সরকার চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই এ বিষাক্ত নেটওয়ার্কিং জাল বন্ধ করতে পারে। এ নৈতিকতাবিনাশী, সস্তা জনপ্রিয়তাবিশিষ্ট, অশ্লীল ও যৌনতা প্রদর্শনের টিকটক মিডিয়াকে একমাত্র দূরে রাখতে পারে ব্যক্তির বিচারবিবেচনাবোধ ও রুচির মাপকাঠি।
হাবিবুর রহমান
শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়