ইসমাইল আলী ; ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। আর পরের দিন সকাল ৬টা থেকে সেতুটি দিয়ে যানবাহন পারাপার শুরু হবে। এজন্য পদ্মা নদীতে বর্তমানে চলাচলরত ফেরির প্রায় দেড়গুণ হারে দিতে হবে টোল। এ টোল থেকে ১৮ বছরেই উঠে যাবে পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয়। এমনটাই প্রক্ষেপণ করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। যদিও টোলের পুরো টাকা বিবিএ পাবে না।
সূত্রমতে, টোলের আয় থেকে প্রথমেই ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কেটে নেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত ঋণের সুদসহ কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এজন্য ৩৫ বছরে পরিশোধ করতে হবে প্রায় ৩৬ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা।
বিবিএ’র হিসাবমতে, উদ্বোধনের পর ২০২২-২৩ অর্থবছর পদ্মা সেতু থেকে টোল আদায় হবে মাত্র ৫৪৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। পরের বছরগুলো তা ক্রমগতভাবে বাড়বে। এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদায় হবে ৬৫৪ কোটি আট লাখ টাকা, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭৮৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৯৪৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা ও ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এক হাজার ১৪১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
সেতুটি উদ্বোধনের ১২তম বছর গিয়ে টোল আদায় দুই হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করবে। অর্থাৎ ২০৩৩-৩৪ অর্থবছরে পদ্মা সেতুতে টোল আদায় হবে দুই হাজার ৭৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। আর সেতুটি উদ্বোধনের ১৯তম বছরে গিয়ে বার্ষিক টোল আদায় তিন হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করবে। অর্থাৎ ২০৪০-৪১ অর্থবছরে সেতুটি থেকে টোল আদায় হবে তিন হাজার ৯৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
যদিও এর আগের বছরই তথা ১৮ বছরে সেতুটির নির্মাণব্যয় উঠে যাবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ২০২২-২৩ থেকে ২০৩৯-৪০ অর্থবছর পর্যন্ত পদ্মা সেতু থেকে টোল আদায় হবে ৩২ হাজার ৬৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। আর পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত মে পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৫৯২ কোটি ২২ লাখ টাকা তথা ৯১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে মূল সেতুর নির্মাণব্যয় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, নদীশাসনে আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা, দুই দিকের সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণে এক হাজার ৭২১ কোটি ১০ লাখ টাকা, পরামর্শক ব্যয় এক হাজার ৯০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা আর জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান ব্যয় ছয় হাজার ৫৪০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
এদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণে ৩০০ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে বিবিএ। বাকি ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এক শতাংশ সুদসহ ৩৫ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যার পরিমাণ ৩৬ হাজার ৪৪০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। প্রতি বছর চার কিস্তি হিসেবে ১৪০টি কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ২৮তম বছর তথা ২০৪৮-৪৯ অর্থবছরে টোল আদায় চার হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করবে। ওই অর্থবছর সেতুটি থেকে টোল আদায় হবে চার হাজার ৫৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। আর উদ্বোধনের ৩৩তম বছরে তথা ২০৫৪-৫৫ অর্থবছর টোল আদায় বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করবে। ওই অর্থবছর সেতুটি থেকে টোল আদায় হবে পাঁচ হাজার সাত কোটি ৫৫ লাখ টাকা। আর ৩৫ বছরে সেতু থেকে মোট টোল আদায় হবে নির্মাণব্যয়ের তিনগুণেরও বেশি। এতে ২০৫৬-২৭ অর্থবছর পর্যন্ত সেতু থেকে মোট টোল আদায় দাঁড়াবে এক লাখ এক হাজার ৩২৪ কোটি ১২ লাখ টাকা।
সূত্রমতে, পদ্মা সেতুর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতি বছর আদায়কৃত টোলের সাড়ে সাত শতাংশ। এছাড়া সেতুর বিনিয়োগের ওপর অবচয় ব্যয় বছরে দুই শতাংশ হারে ধরা হয়েছে। এসব ব্যয় বাদ দিয়ে পদ্মা সেতুর টোল আদায় থেকে মুনাফা হলে তার ওপর আবার ২৫ শতাংশ হারে কর আদায় করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর শোধ করতে হবে ঋণের কিস্তি।
যদিও প্রথম দুই বছর সেতুটি থেকে আদায়কৃত টোলের চেয়ে ব্যয় বেশি হবে। তৃতীয় বছর থেকে মুনাফা শুরু হবে। তবে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে প্রতি বছর বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়তে হবে বিবিএকে। প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, সেতুটি উদ্বোধনের পর ১২ বছর ঋণের কিস্তি শোধে এ ঘাটতি থাকবে। এর পর থেকে মুনাফা শুরু করবে বিবিএ।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতুতে বাইক পারাপারে টোল দিতে হবে ১০০ টাকা। প্রাইভেট কার ও জিপে টোল দিতে হবে ৭৫০ টাকা, পিকআপে এক হাজার ২০০ টাকা এবং মাইক্রোবাসে এক হাজার ৩০০ টাকা। এছাড়া ছোট বাসে (৩১ আসনের কম) টোল এক হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাসে (৩২ আসন বা তার বেশি) দুই হাজার টাকা এবং বড় বাসে (তিন এক্সেল) দুই হাজার ৪০০ টাকা।
পণ্যবাহী যান চলাচলের জন্য ছোট ট্রাকে (পাঁচ টনের কম) টোল এক হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাকে (পাঁচ থেকে আট টন) দুই হাজার ১০০ টাকা এবং বড় ট্রাকে (আট টনের বেশি) দুই হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া পদ্মা সেতুতে তিন এক্সেলের ট্রাকে টোল দিতে হবে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা। এর বাইরে পণ্যবাহী চার এক্সেলের ট্রেইলারে টোল ছয় হাজার টাকা। আর চার এক্সেলের বেশি হলে ছয় হাজার টাকার সঙ্গে পরবর্তী প্রতি এক্সেলের জন্য দেড় হাজার টাকা করে অতিরিক্ত টোল যোগ হবে।
