বিশেষ প্রতিনিধি: গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে পতনের প্রায় দুই মাস আগে ভারতের সঙ্গে বিতর্কিত রেল করিডোর সুবিধা দেয়ার চুক্তি করা হয়েছিল। এছাড়া চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার, সড়ক ও নৌ ট্রানজিটসহ গত দেড় দশকে দেশের স্বার্থবিরোধী বেশকিছু চুক্তি করে শেখ হাসিনা। তবে তার পলায়নের ৫ মাস পেরুলেও এখনও এসব চুক্তি নিয়ে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর দেশটির সঙ্গে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি তুলেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও একই দাবি জানায়। তবে চুক্তিগুলো রিভিজিট (পুনর্মূল্যায়ন) বা খতিয়ে দেখার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত বিতর্কিত রেল ট্রানজিট চুক্তির বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সেটাও স্পষ্ট করা হয়নি। যদিও ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি এখনই বাতিল সম্ভব নয় বলে গত মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের এক উপদেষ্টা উল্লেখ করেছেন।
সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কী কী চুক্তি হয়েছে, তার সংখ্যা ও ধরন বা শর্ত নিয়ে পরিষ্কার তথ্য কমই জানা যায়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও সেগুলো অসম্পূর্ণ। কারণ সরকারি ওয়েবসাইট কিংবা মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত বিশদ তথ্য পাওয়া যায় না। বেশকিছু চুক্তি প্রকাশ করা হয়নি। বরং গত জুনে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত রেল ট্রানজিটসহ অন্য চুক্তিগুলো নিয়ে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছে।
যদিও ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের তথ্যানুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তত ২০টি চুক্তি ও ৬৬টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে। এছাড়া বিভিন্ন সহযোগিতা এবং আগের চুক্তির পরিসরও বাড়ানো হয়েছিল এ সময়। তবে এসব চুক্তির শর্তাদি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাবলিক ডোমেইনে পাওয়া যায় না। এছাড়া সমঝোতা স্মারক পরবর্তী সময়ে চুক্তিতে রূপান্তর হয়েছিল কি না, সেটাও পরিষ্কার জানা যায় না। যেমন চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার নিয়ে ২০১৫ সালে একটি সমঝোতা স্মারক থাকলেও, এ নিয়ে ২০১৮ সালে হওয়া চূড়ান্ত চুক্তির নথি বা তথ্য সরকারিভাবে কোথাও নেই। জুলাইয়ে বাংলাদেশের মোংলা বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব ভারত পেয়েছেÑএমন খবর চীন ও ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এর বিস্তারিত জানানো হয়নি। এসব নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নানা সময়ে সরকার তথা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে এসেছে। জাতীয় সংসদে এসব চুক্তি প্রকাশের নিয়ম থাকলেও কখনোই তা করেনি হাসিনা সরকার। বিরোধী দলগুলো এ নিয়ে বহুবার দাবি জানালেও তাতে কর্ণপাত করেনি আওয়ামী লীগ সরকার।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, দুই দেশের মধ্যকার চুক্তিগুলো পর্যালোচনা হওয়া দরকার। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, কয়েকটা চুক্তির বিষয় পাবলিকলি চলে আসছে। তাতে যতটুকু জানা গেছে ততটুকুই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। আর যতটুকু আসেনি, সেটা তো জানা যায়নি। এসব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ করার দরকার বলেই তার মতামত।
যদিও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি গত মাসে বাংলাদেশ সফরে এসে চুক্তিগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ না করতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে অনুরোধ করেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তবে সে বিষয়েও সরকারের পক্ষ থেকে এখনও স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। প্রসঙ্গত, গত বছরের জুনে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের রেল করিডোর সমঝোতা নিয়ে রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে আদানি গ্রুপকে বাড়তি সুবিধা দেয়া, বেশি খরচ, ক্যাপাসিটি চার্জের মতো দিকগুলোও দেশের স্বার্থের বিপক্ষে গেছে। এছাড়া রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েও ছিল সমালোচনা। এসব বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
যদিও এ বিষয়ে সরকারের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ভারতের সঙ্গে রেল ট্রানজিট চুক্তি বাতিলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কি নাÑজানতে রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে এ বিষয়ে তাকে ম্যাসেজ পাঠানো হলে তিনি তা দেখলেও কোনো উত্তর দেননি। তবে ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিল করা হচ্ছে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। গত ১১ ডিসেম্বর এক সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে পানি সম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ নিয়ে চুক্তিগুলো বাতিল করে দেয়া অত সহজ নয়। চুক্তিগুলো থেকে বের হয়ে আসাও অনেক ব্যয়বহুল। তবুও অন্তর্বর্তী সরকার চ্যালেঞ্জটা নিয়েছে। এখন বিদ্যুৎ চুক্তিগুলো পর্যালোচনার মধ্যে আছে।