ট্রাফিক আইন পরিপালন নিশ্চিত করলে যানজট সমস্যা কমবে

রেজাউল করিম খোকন: বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর এখন ঢাকা। ১৫২টি দেশের ১ হাজার ২০০টির বেশি শহরে যান চলাচলের গতি বিশ্লেষণে এই চিত্র উঠে এসেছে। যান চলাচলে এই ধীরগতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। তিন লাখের বেশি মানুষের বসবাস রয়েছে, এমন সব শহরে গাড়িতে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে কত সময় লেগেছে, সেই তথ্য গুগল ম্যাপ থেকে সংগ্রহ করে গবেষণায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সপ্তাহের বিভিন্ন দিন এবং দিনের বিভিন্ন সময়ে যাতায়াতের তথ্য নেয়া হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গতির ১০০ শহরের মধ্যে ৮৬টিই যুক্তরাষ্ট্রের। প্রতিবেদনে সবচেয়ে দ্রুতগতির যে ২০টি শহরের নাম এসেছে, তার মধ্যে ১৯টি যুক্তরাষ্ট্রের। ধীরগতির শহরের তালিকায় ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশের দুই শহর-ময়মনসিংহ (৯ম) ও চট্টগ্রাম (১২তম) রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধনী দেশগুলোর শহরে গাড়িতে চলাচল দরিদ্র দেশগুলোর তুলনায় ৫০ শতাংশের মতো দ্রুত হয়। এটা সম্ভব হয় ধনী দেশের শহরগুলোতে বড় বড় রাস্তা এবং অনেক ফাঁকা জায়গা থাকার কারণে। এর ফলে রাস্তায় বেশি গাড়ি নেমেও যানজট ছাড়া চলতে পারে। রাস্তায় যানবাহনের চাপ কম থাকার পরেও সবচেয়ে ধীরগতির ২০টি শহরের তালিকাও করা হয়েছে গবেষণায়। সেখানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা। তালিকায় বাংলাদেশের আরও চারটি শহর রয়েছেÑখুলনা (৪র্থ), ময়মনসিংহ (৫ম), চট্টগ্রাম (১৮তম) ও কুমিল্লা (১৯তম)। গবেষণাটির ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী টাইম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকায় মধ্যরাতেও যে দূরত্বে চলাচল করতে আধা ঘণ্টা লাগে, যা বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির শহরে প্রয়োজনীয় সময়ের তিন গুণ বেশি। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাস্তায় চলাচলের গতি ১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়াতে পারলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১০ শতাংশ বাড়ে। গবেষকেরা দেখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোতে গাড়ি ও মানুষের গতি বেশি। আবার দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের শহরে গতি কম। অন্যান্য দরিদ্র দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গতি কম গড়ে ২০ শতাংশ।

নাগরিক গতির একটি নির্ধারক বড় রাস্তা। বড় রাস্তা ভিড় কমায় বিষয়টি এমন নয়, বরং বড় রাস্তা গতি বাড়ায়। দ্বিতীয়ত, শহরে বহু মানুষ কর্মক্ষেত্র, স্কুল ও বিনোদনকেন্দ্রের হাঁটার দূরত্বে বসবাস করে না। তারা দ্রুতগতির এবং বিশ্বস্ত যাতায়াতব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে চায়। আধুনিক মহানগরের প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে দ্রুতগতির যান্ত্রিক যান। জটিল উৎপাদন নেটওয়ার্ক ও বিচিত্র ভোগের বর্তমান শহরে হেঁটে যাতায়াতের চিন্তা মধ্যযুগীয়। যানজট এখন নগরবাসীর নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে, যানজট ছাড়া সপ্তাহের কোনো একটি দিনের কথা কল্পনা করতে পারে না কেউ। আজকাল ছুটি দিনে ঘরের বাইরে বেরোলেও যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে। যানজটের কবলে পড়ে সবার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। যে কারণে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোথাও যাওয়ার চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলছেন কেউ কেউ। যারা পারছেন না তারা যানজটের অভিশাপ মাথায় নিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করছেন এবং প্রতিদিনই নারকীয় অভিজ্ঞতার নিত্যনতুন রূপ দেখছেন। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যানজটই খেয়ে ফেলছে জিডিপির বড় একটি অংশ। সবকিছুর গতি শ্লথকারী এ যানজট দূর করা গেলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বাড়ত আরও। শুধু আর্থিক বিচারেই নয়, যে পরিমাণ ভোগান্তি, আয়ুক্ষয় ও নৈরাজ্য যানজট তৈরি করে, তা জাতীয় জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতি আর ব্যক্তির জন্য তা এক অভিশাপ। যানজট হচ্ছে রাস্তার এমন এক অবস্থা, যেখানে যানবাহনের গতি কমে যায়, যাতায়াতের সময় অযাচিতভাবে বেড়ে যায় এবং যানবাহনের ‘কিউ’ বেড়ে যায় অর্থাৎ সমগ্র রাস্তা অপেক্ষমাণ অথবা ধীরগতিসম্পন্ন যানবাহনে ঠাসা থাকে। যানজট গাড়িচালকদের হতাশা এবং ‘রোড রেজ’ এ আক্রান্ত করে। ‘রোড রেজ’ হচ্ছে গাড়ি চালকদের রাগান্বিত আচরণ বা উদ্ধত আচরণ। রাস্তায় দুর্ঘটনার মূলত এটি অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় যানজট একদশক আগেও এতটা তীব্র ছিল না। দিনে দিনে এখানে যানজট এতটা তীব্র হয়ে উঠছে যে, এর কারণে অচল শহরে পরিণত হতে চলেছে ঢাকা চট্টগ্রাম। যানজট অবসানে সবাই সোচ্চার দাবি জানালেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না, ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরে গত দশ বছরে অনেকগুলো উড়াল সেতু বা ফ্লাইওভার চালু করা হয়েছে বটে, এর মাধ্যমে যানজট কমবে আশা করা হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী যানজট পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি, সরকারি মহল থেকেও যানজট দূরীকরণে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু নির্মম সত্যি হলো, কোনো সরকারই যানজটের অভিশাপ দূর করার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট তা বলা যায় না। প্রকল্পের পর প্রকল্প আসে, অনেক টাকা ব্যয় হয়, কিন্তু সমস্যার তিমির আর দূর হয় না। ক্ষোভের সঙ্গে বলতে হয়, অনেক ক্ষেত্রে সরকার নানাভাবে যানজটের ভয়াবহ এই সমস্যা জিইয়ে রাখছে। যানজটের আর্থিক ক্ষতির হিসাবের মধ্যে সময়ের অপচয়, দেরির কারণে আনুষঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধি, পরিবেশগত ক্ষতি এবং দুর্ঘটনার কারণে জীবনহানি পঙ্গুত্ববরণের বিষয়গুলো উল্লেখ করতেই হয়। যানজটে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হলো মানবিক। আক্ষেপের সঙ্গে বলতে হয় এ শহরের অধিবাসীদের জীবনের অনেক মূল্যবান কিছু বছর চলে যায় কেবল রাস্তা থেমে থাকা গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে করতে। হয়তো এ সময় কাজে লাগিয়ে তারা জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারতেন। উন্নত বিশ্বের নাগরিকদের তুলনায় সর্বক্ষেত্রে আমরা যে পিছিয়ে পড়ছি, তার অন্যতম কারণ কিন্তু এই যানজট। এটা মানতেই হবে যানজটে কেউ খুশি হয় না বরং অসহিষ্ণু আচরণ করে। যানজট মানুষের মনে স্ট্রেস সৃষ্টি করে, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মালামাল পরিবহনে বিঘœ ঘটে, প্রচুর সময় লাগে, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায় এ। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে আবশ্যিকভাবে। আজকাল ঢাকা শহরে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া আসা অনেকে কমিয়ে দিয়েছেন এ যানজটের কারণে। বিয়েশাদির দাওয়াত পেলে অনেকেই বিব্রত বোধ করেন। কারণ যানজট অতিক্রম করে বিয়েশাদির কিংবা অন্যান্য দাওয়াতে সময়মতো পৌঁছানোটা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে এখন। এভাবেই সামাজিক-পারিবারিক সম্পর্ক অনেকটাই হালকা হয়ে যাচ্ছে নিয়মিত যাওয়া আসা না থাকার কারণে। যানজট পারিবারিক সামাজিক বন্ধন অটুট রাখার পথে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, আমরা সবাই অসহায়ভাবে যানজটের কাছে জিšি§ হয়ে পড়ছি।

চট্টগ্রামে গত এক দশকে সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নে ১২ হাজার কোটি টাকায় অন্তত ২৩টি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও যানজট না কমে বেড়েছে। নগরের বিভিন্ন এলাকায় দিনের বিভিন্ন সময়ে যানজট লেগে থাকছে। যানজটের মূল কারণ চিহ্নিত না করে শুধু সড়ক সম্প্রসারণ, উড়ালসড়ক ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করলে যানজট দূর হবে না। নগরের যানজট নিরসন করার জন্য যা যা প্রয়োজন, তা না করে ইচ্ছামতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আবার প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও এর জন্য যে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দরকার ছিল, তাতে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এক দশক ধরেই ময়মনসিংহ নগরে যানজট বাড়ছে। বর্তমানে তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। নগরের প্রধান প্রধান সড়কসহ প্রায় সব সড়কই সরু। নগরে মানুষ বাড়লেও সড়ক উন্নয়ন হয়নি। এছাড়া অবৈধ যানবাহন চলাচল ও রেললাইন যানজটের বড় কারণ। যানজট নিরসনের জন্য সড়কগুলো প্রশস্ত করা এবং যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক জরিপ প্রতিবেদন তুলে ধরে জানায়, ঢাকাবাসীকে সড়কে প্রতি ২ ঘণ্টায় ৪৬ মিনিট কাটাতে হয় যানজটে বসে। বছরে জনপ্রতি গড়ে ২৭৬ ঘণ্টা নষ্ট হয় যানজটে।

মানুষের চলাচল এখন একটি জরুরি বিষয়। শহর গড়ে উঠেছে এ কারণে যেখানে অল্প জায়গায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদনের সুবিধা থাকবে। মানুষ দ্রুত চলাচল করে সেই সুবিধা নিতে পারবে। ঢাকায় দ্রুত চলাচলের সুবিধা নেই। দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা বদলে এখানে স্বল্প মেয়াদে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। এখন বড় বড় প্রকল্প নেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা ছাড়া শুধু উন্নয়ন প্রকল্প দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। শহরে ছোট গাড়ি, রিকশা ও মোটরসাইকেল কমাতে হবে। তা না করে এখানে করা হয়েছে উল্টো। এর ফলে বিপুল ব্যয়ে প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা যাচ্ছে না। রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে, বলা যাবে না। সব সড়কেই এখন যানজট আগের মতোই। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোতে যানজটের ভয়াবহতা বেশি। সবার মধ্যে প্রত্যাশা ছিল, গেল ১২ বছরে রাজধানীর এই নাগরিক দুর্ভোগ অনেকটাই কমে আসবে। এ সমস্যা সমাধানে গত দুই দশকে নানা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যেগুলো বাস্তবায়নে আলোর মুখ দেখেছে। তা দিয়ে কি প্রকৃত অর্থেই এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব হয়েছে? একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এমন প্রশ্ন যে কারও হতে পারে। বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারীর দৃষ্টি এখন ঢাকার দিকে। তারা যখন এই শহরে আসা মাত্রই যানজটের ভোগান্তিতে পড়েন তখন উৎসাহে কিছুটা হলেও ধাক্কা লাগা স্বাভাবিক। এসব বিবেচনায় প্রশ্ন উঠতেই পারে এটা কেমন শহর! যে শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় যানজটের কারণে বসে থাকতে হয়। সমস্যা সমাধানে শত ছাপিয়ে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া ছাড়া কি আর কোনো উপায় নেই? যে উপায় পরিস্থিতিকে অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে। অবশ্যই আছে। বড় বিনিয়োগ ছাড়া যানজট কমাতে যেসব বিকল্প সামনে আছে, সেগুলো দীর্ঘদিন আলোচনার টেবিলেই সাজানো। এসব বিকল্পে সরকার, পরামর্শকসহ দাতা সংস্থার একেবারেই উৎসাহ কম তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু সময়ের বাস্তবতা বলছে, বিপুল অর্থের প্রকল্প না নিয়ে যানজট রোধে বিকল্প ভাবনা অনেক কাজে দিতে পারে।

যানজট নিরসনে এখন রাজধানীতে মেট্রোরেল প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি’র কাজও চলছে পুরোদমে। আরও কিছু সম্ভাবনাময় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে আরও ছয়টি মেট্রোরেল নির্মাণের কথা রয়েছে। এ সময়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ আসবে রেল নেটওয়ার্কের আওতায়। সাম্প্র্রতিক সময়ে বেশ কটি উড়াল সড়কের কাজ শেষ হয়েছে রাজধানীতে। অথচ যানজটের মাত্রা কিন্তু কমেনি। বরং বাড়ছে। তবে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে সেগুলো না হলে সমস্যা আরও বাড়ত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। একদিকে নগরকেন্দ্রিক যানজট নিরসনে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। অপরদিকে পাল্লা দিয়ে মানুষ বাড়ছে রাজধানী ঢাকায়। এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। যারা গ্রাম বা মফস্বল ছেড়ে ঢাকায় আসছেন, তাদের বেশিরভাগের উদ্দেশ্য চাকরি। আরেকটি অংশ আসছে উন্নত পড়াশোনার তাগিদে। নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে যে অংশটি রাজধানীতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে সেই সংখ্যা নগণ্য। তবে চিকিৎসার প্রয়োজনে আরেকটি বড় অংশ এই শহরে নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন। আর বিভিন্ন অফিসের কাজে নিয়মিত আসা যাওয়া তো আছেই। আরেকটি অংশ আছে যাদের এই শহরে কোনো কাজ না থাকলেও অর্থ আছে, তাই উন্নত নাগরিক জীবনযাপনের প্রয়োজনে থাকেন। এখন বাড়ছে হাতপাতা মানুষের সংখ্যা। সেই সঙ্গে একেবারেই প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাও ঢাকায় নেহাত কম নয়।

’৯০ দশক থেকেই রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। ২০০১ সালের পর তা আরও গতি পেয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পেই শুধু যানজট কমবে না। এজন্য সব ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বিকেন্দ্রীকরণ। অর্থাৎ ঢাকামুখী মানুষের গ্রোথে যদি কমানো সম্ভব না হয়, তাহলে যানজট নিরসন একেবারেই সম্ভব হবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও, বিকেন্দ্রীকরণে সরকারের তেমন উদ্যোগ নেই। গত ১২ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কোনো তথ্য প্রকাশের খবর জানা নেই।  একটি প্রকল্পের সুফল যদি কোটি মানুষের জন্য ধরা হয় তবে একটি প্রকল্প বাস্তবান করতে করতে নতুন করে এ শহরে আরও অন্তত ৫০ লাখ মানুষ এসে যুক্ত হয়। তারপর আরেকটি পরিকল্পনা শেষে অন্তত পাঁচ বছর পর তা বাস্তবায়ন শুরু হলেÑ শেষ হতে সময় লাগে মেয়াদের দ্বিগুণ। এ সময়ে আরও কত মানুষ শহরে আসে? এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে যানজট রোধ করা কি সম্ভব হবে? ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চলাচলের জন্য উপযুক্ত শহরের জন্য ২৫ ভাগ রাস্তার প্রয়োজন। আছে মাত্র আট ভাগ। এর মধ্যে দুই ভাগের বেশি থাকে দখলে। ছয় ভাগ সড়কে নিবন্ধিত ১৬ লাখ যানবাহন চলছে। এর বাইরে আরও রয়েছে অন্তত ১০ লাখ যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন। প্রতিদিন রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে অন্তত লক্ষাধিক যানবাহন এসে নগরে শামিল হয়। অথচ এ শহর তিন লাখ যানবাহন চলাচলের উপযোগী। সব মিলিয়ে যানবাহনের ভারে একেবারেই কাহিল অবস্থা শহরটির। মানুষ আর মাত্রাতিরিক্ত গাড়ির চাপে এই শহর এখন বেসামাল। অর্থাৎ নানা সূচকে বসবাসের অযোগ্য। তাই বলে কি বসে থাকলে চলবে না। নগরবাসীকে যানজটের এই মহাদুর্ভোগ থেকে স্বস্তি দিতে সবার আগে জরুরি প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিকেন্দ্রীকরণ। উদ্যোগ নিতে হবে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানাগুলোকে যেকোনো মূল্যে নগরীর বাইরে নেয়ার। নতুন করে শহরে কোনো শিল্প কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেয়া না হলেও এখন সময়ের দাবি পুরোনোগুলোকে মফস্বল শহরে নেয়া। এখন সারাদেশে খুব ভালো যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। তাই পণ্য আনা-নেয়ায় কোনো সমস্যা হবে না। এতে ঢাকার ওপর অনেকটাই চাপ কমবে। শ্রমিকরাও মফস্বল শহরে আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারবেন। বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসও বিভাগীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। অনলাইন-নির্ভর নাগরিকসেবা আরও বেশি বাড়ানো সম্ভব হলে মানুষ কম ঘর থেকে বের হবেন। তাছাড়া নাগরিক সেবায় ভোগান্তি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। নগরীতে যুক্ত হওয়া নতুন এলাকাগুলোতে যেন পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। সে সঙ্গে সরু রাস্তাগুলো আরেকটু প্রসারিত যেমন করা জরুরি তেমনি নতুন রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে পিছপা হওয়া যাবে না। বস্তিবাসীসহ ছোট ভাসমান বা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের একটি অংশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজ এলাকায় পুনর্বাসন করা যেতে পারে। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো, ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে শুধু পুলিশ দায়িত্ব পালন করে থাকে। আর বাদবাকি রাস্তায় কী হচ্ছে তা দেখার কেউ নেই। যেমন, রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়ে থাকে। রাস্তা দখল করে পার্কিং, মালামাল রাখা, ইচ্ছামতো যাত্রী ওঠানো-নামানো, যাত্রীর জন্য বাসগুলোকে বসে থাকা, যেখানে সেখানে টেম্পো স্ট্যান্ডসহ নানা কারণে সড়কে যানজট লেগে থাকে। অর্থাৎ আইন না মানার প্রবণতা রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। তাই রাস্তায় পুলিশি নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি আরও বেশি স্থাপন করতে হবে সিসি ক্যামেরাও। কেউ আইন ভঙ্গ করলে সঙ্গে সঙ্গে নিতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ট্রাফিক আইনভঙ্গের কারণে কোনো গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা, চালকের পয়েন্ট কাটা গেলেই মানুষ আইন মানতে বাধ্য। এভাবে সবার মধ্যে অল্পদিনের মধ্যেই সচেতনতা সৃষ্টি হবে। তবেই নগরীর যানজট পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক করা হয়ত সম্ভব। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বিদ্যমান সব বাধা অতিক্রম করতে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। যানজট দূরীকরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে আগামীতে অর্থনীতিতে সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক