Print Date & Time : 7 July 2025 Monday 5:09 am

ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ৯০ দিন স্থগিত

শেয়ার বিজ ডেস্ক: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ওপর যে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিলেন, তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ সময় দেশগুলোর পণ্যে পাল্টা শুল্ক ন্যূনতম ১০ শতাংশ কার্যকর হবে। তবে চীনের পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ ঘোষণা করেন তিনি। গত বুধবার নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেয়া এক পোস্টে এ ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।

এদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েক ডজন দেশের ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্ক সাময়িকভাবে কমানোর পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন মার্কিন শুল্কের বিরুদ্ধে তাদের প্রথম পাল্টা ব্যবস্থা স্থগিত করবে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডের লেইন গতকাল বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছেন।

পাল্টা শুল্ক স্থগিতের বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘চীন বিশ্বের বাজারগুলোর প্রতি শ্রদ্ধার যে ঘাটতি দেখিয়েছে,

তার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ ধার্য করছি।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘ভবিষ্যতে চীন ও অন্যান্য দেশ উপলব্ধি করতে পারবে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণার দিন আর থাকবে না বা গ্রহণযোগ্য হবে না।’

ট্রাম্প বলেছেন, ‘গত কয়েক দিন ধরেই শুল্কের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছি। বোধহয় বুধবার সকালে সব আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন কোনো আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের সময় ছিল না। কেবল নিজের অন্তরের কথা শুনে যেটি সঠিক মনে হয়েছে, সেটাই করেছি।’ বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক ও অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্টের সঙ্গে মিলে ট্রাম্প এই পোস্ট লিখেছিলেন বলে জানান লুটনিক। তবে অনেক রিপাবলিকান আইনপ্রণেতার কাছেই এ ঘোষণা ছিল বিস্ময়কর।

এর আগে চীনা পণ্যের ওপর মার্কিন প্রশাসন ১০৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে চীন। বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির এই পাল্টা-পাল্টি পদক্ষেপে বাণিজ্যযুদ্ধ আরও তীব্র হয়। চীনা পণ্যে নতুন করে শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, ‘বিশ্ববাজারের প্রতি চীন যে অসম্মান দেখিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করার ঘোষণা দিচ্ছি। এটি এখন থেকেই কার্যকর হবে। অদূর ভবিষ্যতে চীন হয়তো এটা বুঝতে সক্ষম হবে যে, তাদের অন্য দেশগুলো ও আমেরিকার ক্ষতি করার দিন শেষ হয়ে এসেছে।’ তবে ট্রাম্প আরও বাণিজ্যের ব্যাপারে আগ্রহী এবং প্রশাসনও আলোচনার জন্য প্রস্তুত বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট।

ট্রাম্পের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় আগামী মঙ্গলবার থেকে মার্কিন আমদানির প্রায় ২১ বিলিয়ন ইউরো (২৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার) এর ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ শুরু করার কথা ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের। তবে রপ্তানি করা গাড়ির শুল্ক এবং এখনও বহাল থাকা বৃহত্তর ১০ শতাংশ শুল্কের প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে তা এখনও মূল্যায়ন করছে এই ব্লক। ভন ডের লেইন এক্স-এ লিখেছেন, ‘আমরা আলোচনার সুযোগ দিতে চাই। আমাদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে জোরালো সমর্থন পাওয়া ইইউ পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি আমরা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখব।’

অন্য দেশগুলোর ওপর আরোপ করা পারস্পরিক শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করার বিষয়টি জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্র–থ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘বিপরীতভাবে ৭৫টিরও বেশি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের বাণিজ্য, বাণিজ্য বাধা, শুল্ক, মুদ্রা জালিয়াতি, অ-আর্থিক শুল্ক নিয়ে আলোচনার জন্য ডেকেছে এবং এই দেশগুলো আমার শক্তিশালী পরামর্শের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেয়নি। তাদের জন্য আমি শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছি এবং পারস্পরিক শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে এনেছি, যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। বিষয়টিতে মনোযোগ দেয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ।’

তবে যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য সরবরাহে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত। সেই সুযোগ রাখা হয়নি। বিশ্বের সব দেশকে ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে মার্কিনিদের কাছে পণ্য পাঠাতে হবে। বাংলাদেশি পণ্যে আগে থেকেই গড়ে ১৫ শতাংশ করে শুল্ক ছিল।

এক্স-এ দেয়া এক পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী লুটনিক বলেন, ‘আমি এবং বেসেন্ট প্রেসিডেন্টের সঙ্গেই ছিলাম যখন তিনি অসাধারণ এই পোস্টটি করেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশ্ব বাণিজ্য ঠিক করার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত আর চীন বিপরীত পথে হাঁটছে।’

এর আগে স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি বলেন, ‘পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগেই বিশ্বনেতারা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, চেষ্টা করছেন শুল্ক কমাতে।’ ট্রাম্পের ভাষায়, ‘বিশ্বনেতারা এখন আমাকে ‘স্যার’ ‘স্যার’ করছেন। আমার পায়ে পড়ছেন। তারা আমাদের সঙ্গে চুক্তি করতে মরিয়া।’

হোয়াইট হাউসের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা নতুন শুল্ক কমাতে এরই মধ্যে ইসরায়েল চুক্তির চেষ্টা করছে। তাদের প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটনে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে রয়েছে। আগামী সপ্তাহে ওয়াশিংটন সফর করবেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী।

এদিকে পারস্পরিক শুল্ক আরোপে ট্রাম্পের সাময়িক বিরতি দেয়ার ঘোষণার পরপরই বিশ্ব শেয়ার বাজারে দেখা গেছে নজিরবিহীন উল্লম্ফন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এটি মার্কিন বাজারে তৃতীয় সর্বোচ্চ দৈনিক উত্থান বলে জানিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকরা। গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের নির্দেশনায় জানানো হয়, চীন বাদে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়েছে, যা বাজারে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্কনীতির কারণে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। আমেরিকান বন্ড ও ডলারের মূল্যও নিম্নমুখী ছিল। তবে হঠাৎ করে ট্রাম্পের অবস্থান বদলে দেয়ায় বাজার দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের পাল্টা শুল্ক স্থগিতাদেশের পরও স্বস্তিতে নেই বিশ্ব। বরং ট্রাম্পের সর্বশেষ সিদ্ধান্তেও বিশ্বের আর্থিক মন্দা কাটানো যাবে নাÑএমনটাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং সংস্থা জেপি মরগ্যান চেজ দাবি করে, ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির ফলে বিশ্ব ৬০ শতাংশ মন্দার মুখে পড়তে যাচ্ছে। আন্তর্দেশীয় বাণিজ্য-সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতিতে বারবার রদবদলের প্রভাব পড়তে চলেছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আর্থিক বিকাশেও। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়; বিশ্বব্যাপী মন্দার জš§ দিতে পারে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

জেপি মরগ্যানের মতোই সতর্কবার্তা দিয়েছেন মার্কিন পরামর্শদাতা সংস্থা আরএসএম ইউএসের প্রধান অর্থনীতিবিদ জো ব্রুসুয়েলাস। তিনিও জানিয়েছেন, শুল্কনীতিতে সাময়িক স্থগিতাদেশ মন্দা রোধ করার জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে। গোল্ডম্যান স্যাক্সের অর্থনীতিবিদরাও আগামী ১২ মাসে অন্তত ৪৫ শতাংশ মন্দার পূর্বাভাস দিয়েছেন।

বুধবার রাতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জেপি মরগ্যানের অর্থনীতিবিদরা লিখেছেন, ‘‘অন্য সব বাদ দিয়ে দেখলে ‘মুক্তি দিবসে’ ঘোষিত চড়া শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটি অবশ্যই ইতিবাচক। তবে অন্য সবকিছু বাদ দেয়া সহজ নয়। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তা এখনও উদ্বেগজনক।’’

বিশেষজ্ঞদের আরও মত, এখনও ১০ শতাংশ সর্বজনীন শুল্ক আগের মতোই বহাল রয়েছে, যা বিশ্ববাজারে ‘বড় ধাক্কা’ দিতে পারে। এমনকি এই ধাক্কা হতে পারে ২০১৮-১৯ সালের বাণিজ্যযুদ্ধের ধাক্কার সাড়ে ৭ গুণের সমান! তাছাড়া চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ১২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা প্রায় ৮৬০ বিলিয়ন ডলার কর বৃদ্ধির সমান। এর পরেই প্রতিবেদনে তারা লিখেছেন, ‘মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি, বরং এটা কেবল শুরুর শেষ।’