শেয়ার বিজ ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চার দিনের উপসাগরীয় সফর শেষ করে শুক্রবার বিকালে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ত্যাগ করেছেন। সফরে তিনি সৌদি আরব, কাতার ও আমিরাত ভ্রমণ করেন। কায়রো থেকে সিনহুয়া জানায়, গাজা সংকট প্রশমনে ও আঞ্চলিক উত্তেজনা কমাতে ট্রাম্পের সফর কিছুটা আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যে তার সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করা। সফরের প্রতিটি ধাপে তিনি ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি নিশ্চিত করেছেন। খবর: বাসস।
বিশ্লেষকদের মতে, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলো এড়িয়ে কেবল ব্যবসায়িক দিকেই মনোযোগ দেয়ায় ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে একটি দৃষ্টিগোচর পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরজুড়ে ছিল বিশাল বাণিজ্যিক চুক্তির আয়োজন। দ্বিতীয় মেয়াদের শুরু থেকেই ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তার প্রথম বড় বিদেশ সফরের কেন্দ্রবিন্দু হবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ। জানুয়ারিতে অভিষেকের দিন তিনি বলেছিলেন, ‘যদি সৌদি আরব ৪৫০ বা ৫০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কিনতে চায়, তবে আমি প্রথমে সৌদি আরবেই যাব।’
গত মঙ্গলবার সৌদি আরবে পৌঁছানোর পর ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি করেন ট্রাম্প। এর মধ্যে ছিল ইতিহাসের সর্ববৃহৎ প্রতিরক্ষা চুক্তি, ১৪২ বিলিয়ন ডলারের, যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে আধুনিক যুদ্ধসজ্জা ও ১২টিরও বেশি মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানির সেবা সরবরাহ করবে। কাতারে ট্রাম্প ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক বিনিময় ও ২৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চুক্তি করেন। এর মধ্যে কাতার এয়ারওয়েজের জন্য ৯৬ বিলিয়ন ডলারে বোয়িংয়ের ৭৮৭ ড্রিমলাইনার ও ৭৭৭এক্স সিরিজের ২১০টি বিমান কেনা অন্তর্ভুক্ত। সফরের শেষ গন্তব্য ইউএইতে ট্রাম্প ২০০ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির ঘোষণা দেন। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, উপসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে বিনিয়োগ চুক্তির মোট পরিমাণ দাঁড়ায় দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি।’
লোয়ি ইনস্টিটিউটের মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক রজার শানাহান বলেন, ‘ট্রাম্পের এই সফর পুরোপুরি অর্থ নিয়েই। উপসাগরীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রে বিশাল বিনিয়োগের উৎসÑএটি দেখানোর জন্য এমন সফর উপযুক্ত।’
অনেকে আশা করেছিল, ইসরাইলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ব্যবহার করে ওয়াশিংটন হয়তো গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে ট্রাম্প প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
সফরের সময় ইসরাইল গাজায় দৈনিক ভিত্তিতে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়ে যায়, যাতে প্রতিদিনই বহু মানুষ নিহত হয়। ইয়েমেনে হুথি বাহিনীর সঙ্গে ইসরাইলের পাল্টাপাল্টি হামলা চলতে থাকে। এ ছাড়া লেবাননের ওপর নিয়মিত ইসরাইলি বিমান হামলায় বহু প্রাণহানি ঘটে।
মিসরের গবেষক মোস্তাফা আমিন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র মুখে শান্তির কথা বললেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ট্রাম্প সফরের সময় গাজায় নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যা শান্তি প্রচেষ্টার আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।’
দোহায় কাতারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক গোলটেবিল বৈঠকে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি চাই যুক্তরাষ্ট্র গাজাকে ফ্রিডম জোন বানাক, সেখানকার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করুক।’ তিনি যোগ করেন, ‘মানুষদের নিরাপদ ঘরে বসবাস করানো হোক, আর হামাসকে দমন করতেই হবে।’
পশ্চিম তীরের আরব আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক আমজাদ আবু আল-ইজ বলেন, ‘তিনি শুধু পণবন্দিদের মুক্তির প্রসঙ্গেই শান্তির কথা বলেছেন। যুদ্ধবিরতি, উত্তেজনা প্রশমন বা গাজায় মানবিক করিডোরের বিষয়টি একবারও তোলেননি।’
ট্রাম্প সফরে ইরানকেও ছাড় দেননি। তিনি ইরানকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক শক্তি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে আঞ্চলিক অস্থিরতার জন্য দায়ী করেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান এর কঠোর প্রতিবাদ জানান, যা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়ায়। আমিরাতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলি জোহর বলেন, ‘ট্রাম্পের সফরে যুক্তরাষ্ট্র কিছু অর্থনৈতিক সাফল্য পেলেও মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মূল কারণগুলোর কোনো স্পষ্ট সমাধান তুলে ধরেনি।’
এই সফর শুধু আরব বিশ্বের উদ্বেগ উপেক্ষাই করেনি, বরং ইসরাইলের অনুভূতিকেও পাশ কাটিয়েছে। ২০১৭ সালের মতো এই সফরে ট্রাম্প ইসরাইল সফরে যাননি। বরং সফরের আগের দিন গুজব ওঠে যে যুক্তরাষ্ট্র হামাসের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছে এবং এর ফলে আমেরিকান-ইসরাইলি জিম্মি এদান আলেক্সান্ডার মুক্তি পান।
আল জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ‘ট্রাম্পের সফরে ইসরাইল উপেক্ষিত হওয়াকে ওয়াশিংটন ও নেতানিয়াহু সরকারের সম্পর্কের অবনতির প্রতিফলন হিসেবে দেখা হচ্ছে।’ আমিরাতে অবস্থানকালে ট্রাম্প বলেন, ‘গাজায় বহু মানুষ অনাহারে আছে’Ñ এ বক্তব্য অনেকেই ইসরাইলের যুদ্ধনীতির প্রতি তার বিরক্তির ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘আমেরিকা প্রথম’ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচিত প্রবক্তা ট্রাম্প হয়তো ইসরাইল নিয়ে ধৈর্য হারাচ্ছেন। টাইমস অব ইসরায়েল-এর মতে, ‘দশকের পর দশক ধরে ইসরাইল ওয়াশিংটনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। এখন মনে হচ্ছে, হোয়াইট হাউসে তাদের সবচেয়ে ভালো মিত্র আগ্রহ হারাচ্ছে।’
আটলান্টিক কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ফ্রেডরিক কেম্পে বলেন, ‘ট্রাম্প প্রশাসন এখন উপসাগরীয় বিনিয়োগের স্রোতে সাঁতার কাটতে চাইছে, একঘেয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে নয়।’
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক খায়ের দিয়াবাত বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের মনোযোগ ও নীতিগত অগ্রাধিকার উপসাগরীয় অর্থনীতির দিকে সরিয়ে নিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘অবশ্যই অর্থনৈতিক সহযোগিতা অঞ্চলটির জন্য উপকারী, তবে এখন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে তাদের দায়িত্ব পালন করা এবং মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করা।’