ঠাকুরগাঁওয়ে বিলুপ্তির পথে গরু-মহিষের গাড়ি

শামসুল আলম, ঠাকুরগাঁও:‘ওকি গাড়িয়াল ভাইÑকত রব আমি পন্থের পানে চাইয়া রে’-গ্রামবাংলার জনপ্রিয় এই গানটি যেমন এখন আর শোনা যায় না, তেমনি গ্রামবাংলার একটি জনপ্রিয় যান গরু-মহিষের গাড়িও এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না। হারিয়ে যাচ্ছে গাড়িয়াল পেশাও। এখন আর গ্রামগঞ্জে আগের মতো চোখে পড়ে না গরু-মহিষের গাড়ি, যা দুই যুগ আগে ঠাকুরগাঁও বিভিন্ন উপজেলায় ঐতিহ্যবাহী গরু-মহিষের গাড়ি বাহনের সরগরম অস্তিত্ব ছিল। ছিল সর্বত্র এ গরু-মহিষের গাড়ির কদর। কী বিয়ে, কী অন্য কোনো উৎসব গরু না হয় মহিষের গাড়ি ছাড়া যেন কল্পনাই করা যেত না।

পল্লি এলাকার জনপ্রিয় বাহন ছিল গরু-মহিষের গাড়ি। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলের কৃষি ফসল বহন ও মানুষ বহনের প্রিয় বাহন ছিল দু-চাকার এই গরু-মহিষের গাড়ি। যুগের পরিবর্তনে এ বাহন এখন হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাংলার জনপ্রিয় গরু-মহিষের গাড়ি এখন অধিকাংশ এলাকা থেকে বিলুপ্তির পথে।

এখন এসব বাহন রূপকথার গল্পমাত্র, বাংলা নববর্ষ পালনের সময় ২-৪টি গরু-মহিষের গাড়ি দেখা গেলেও সেটা বিলুপ্তির পথে। মাঝে মধ্যে প্রত্যন্ত এলাকায় দু-একটি গরু-মহিষের গাড়ি চোখে পড়লেও শহর এলাকায় একেবারেই দেখা যায় না। আধুনিক সভ্যতায় ঐতিহ্যবাহী গরু-মহিষের গাড়ি হারিয়ে যেতে বসেছে। সে কারণে শহরের ছেলেমেয়েরা দূরের কথা, বর্তমানে গ্রামের ছেলেমেয়েরাও গরু-কিংবা মহিষের গাড়ির শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়। আবার অনেক শহরে শিশু গরু-মহিষের গাড়ি দেখলে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করে এই গাড়ি সম্পর্কে।

যুগ যুগ ধরে কৃষকের কৃষি ফসল রোপণ ও বহনের গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে পরিচিত ছিল গরু-মহিষের গাড়ি। এ গাড়ি দুই চাকাবিশিষ্ট গরু বা মহিষে টানা এক প্রকার বিশেষ যান। এ যানে সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সঙ্গে চাকা দুটি যুক্ত থাকে। গাড়ির সামনের দিকে একটি জোঁয়ালের সঙ্গে দুটি গরু বা বলদ এবং মহিষ জুটি মিলে গাড়ি টেনে নিয়ে চলে। সাধারণত চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। আর পেছনে বসেন যাত্রীরা। বিভিন্ন মালপত্র বহন করা হয় গাড়ির পেছন দিকে। বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজে গরু-মহিষের গাড়ির প্রচলন ছিল ব্যাপক। গ্রামবাংলায় ঐতিহ্যগতভাবে গরু-মহিষের গাড়ি দু দশক আগেও যাতায়াত ও মালবহনের কাজে ব্যবহƒত হতো।

কৃষকরা প্রতিদিন ফজরের আজানের আগে গরু নচেৎ মহিষের গাড়িতে কখনও জৈব সার তথা গোবরের সার, কখনও গরুর খাবার ও লাঙ্গল-মই-জোঁয়াল নিয়ে যেত মাঠে। গরুর গাড়ির চালককে বলা হয় গাড়িওয়াল। ২০ থেকে ৪০ কিলোমিটারের রাস্তা পাড়ি দিয়ে কৃষকেরা জমি চাষাবাদ এবং মালামাল বহনের জন্য গরু-মহিষের গাড়ি বাহন হিসেবে ব্যবহার করত। অনেক এলাকার রাস্তা পাকা না থাকায় যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করত না। ফলে গরু-মহিষের গাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা। তবে বর্তমানে টলি, ভ্যান, টেম্পো, নসিমন, আটো, উদাম পরিবহন করিমনসহ নানা ধরনের মোটরযান চলাচলের কারণে অপেক্ষাকৃত ধীরগতির এই যানটির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে।

এখন গরু-মহিষের গাড়ি ধীরগতির কারণে অচল হয়ে পড়েছে, এখন এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। গ্রামবাংলার ভাষায় মহিষ গাড়ি চালককে, মহিষ গাড়ির মাহান বলে থাকে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জামালপুর এলাকার মহিষের গাড়ি চালক নজবুল বলেন, আমার বাপ-দাদারা মহিষের গাড়ি চালিয়ে জীবনযাপন করেছেন। আমি নিজেও ৪০ বছর এ পেশার সঙ্গে জড়িত আছি। আমার নিজের গ্রাম কিংবা অন্য গ্রামের যারা জৈব সার, গোবরের সার আবাদ স্থলে পৌঁছিয়ে নেয় তাদের কাছ থেকে আমি প্রতি গাড়ি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে নিই।

তিনি বলেন, বর্তমান যুগ হচ্ছে যান্ত্রিক যুগ। মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় মালামাল বহনের জন্য বাহন হিসেবে ব্যবহার করছে ট্রাক, পাওয়ার টিলার, লরি, নসিমন-করিমনসহ বিভিন্ন মালগাড়ি। মানুষের যাতায়াতের জন্য রয়েছে মোটরগাড়ি, বেবিট্যাক্সি, অটোরিকশা ইত্যাদি। ফলে গ্রামে আর চোখে পড়ে না গরু-মহিষের গাড়ি। অথচ গরু-মহিষের গাড়ির একটি সুবিধা ছিল, এতে কোনো জ্বালানি লাগে না। ফলে ধোঁয়া হয় না। পরিবেশের কোনো ক্ষতিও করে না। এটি পরিবেশবান্ধব একটি যানবাহন। শব্দদূষণ নেই। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ এসব কিছুই এই যানে ব্যবহার হয় না। এই গরু-আর মহিষের গাড়ি ধীর গতিতে চলে বলে তেমন কোনো দুর্ঘটনাও নেই। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে আমাদের প্রিয় এই গরু আর মহিষের গাড়ির প্রচলন আজ হারিয়ে যাচ্ছে।

পীরগঞ্জ উপজেলার কেষরানীগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে গরু-মহিষের গাড়ি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হতে দেখেছি। এখন গরু-মহিষের গাড়ি তেমন ব্যবহার হয় না। এখন মানুষ মাহিন্দ্রা, পাওয়ারট্রলি ও ট্রাক্টরসহ ইঞ্জিনচালিত গাড়ি দিয়ে যাতায়াতসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে।