ডলারের আধিপত্য কমাতে ব্রিকস কি নিজস্ব মুদ্রা চালু করবে?

রেজাউল করিম খোকন: দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিকাশমান পাঁচ অর্থনীতির জোট ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলন। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার (ব্রিকস) এই জোট এখন বিশ্ব মঞ্চে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে (সম্মেলনে সংস্থায় নতুন ৬ সদস্য নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে)। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৈশ্বিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের নানা উদ্যোগকে ব্রিকস যে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, কূটনৈতিক দিক থেকে সেই নিষেধাজ্ঞাকে ব্রিকস প্রচ্ছন্নভাবে খাটো করেছে। ডলারকে দুর্বল করে দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রার মর্যাদা থেকে তাকে নামিয়ে আনার চেষ্টাও ব্রিকস দেশগুলো করে যাচ্ছে। ব্রিকসের সদস্য হতে আগ্রহী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ইরান, কিউবা ও ভেনেজুয়েলার মতো দেশও আছে। অর্থাৎ ব্রিকস দিন দিন যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে তাতে সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় ওয়াশিংটন কী করবে এবং ব্রিকসের কাজকর্মের প্রতিক্রিয়া জানাবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনা আধিপত্যের অধীনে থাকা ব্রিকস নামের এই গ্রুপ মার্কিন স্বার্থবিরোধী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের নীতি অনুসরণ করে থাকে বলে সাধারণভাবে যা বলা হয়ে থাকে, তা আসলে ঠিক নয়। বরং ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো অভিন্ন উন্নয়ন স্বার্থ ও বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থার অন্বেষণে পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে যেখানে কোনো একক শক্তির আধিপত্য নেই। তবে এটি সত্য যে ব্রিকসে জড়ো হওয়া দেশগুলো একটি শক্তিশালী গ্রুপে পরিণত হয়েছে, যা এখন ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করে বসছে। এ কারণে ব্রিকসকে বৃহৎ নীতি শক্তি হিসেবে গণনা না করা এবং উদীয়মান শক্তি হিসেবে তাকে উপেক্ষা করা আর যুক্তরাষ্ট্রের সাধ্যের মধ্যে নেই। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শিবশঙ্কর মেনন নিশ্চিত করে বলেছিলেন, তাদের এই সংগঠনের লক্ষ্য কোনোভাবেই মার্কিন স্বার্থের বিরোধিতা করা নয়। চীন ও রাশিয়া ডলারের আধিপত্যকে খর্ব করার জন্য সংগঠনটিকে ব্যবহার করছে বলে যেসব অভিযোগ উঠেছিল, তা-ও তিনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আজকে ব্রিকসের আওতায় বিশ্বের ৪১ শতাংশ মানুষ, ৩১.৫ শতাংশ বৈশ্বিক জিডিপি এবং ১৬ শতাংশ বৈশ্বিক বাণিজ্য। এই অবস্থায় যদি সদস্যরাষ্ট্রগুলো এক হয়, তাহলে তারা বৈশ্বিক দর-কষাকষির একটি বৃহৎ শক্তি হয়ে দাঁড়াবে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে তারা ঘনিষ্ঠ হচ্ছেও।

ইউক্রেন যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা যখন রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আটকে ফেলতে চাইছে, সে মুহূর্তে মস্কোর ব্রিকস অংশীদাররা তাকে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখার জোরালো আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। ব্রাজিল, ভারত ও চীন মস্কোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক অনেক গুণ বাড়িয়েছে। বিশেষ করে এসব দেশ এখন রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি বাজার হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে যে ঐক্যের শক্তি গড়ে উঠেছে, তা বাইডেন প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক স্বার্থ ব্রিকসের কারণে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা হিসাব-নিকাশের মধ্যে আনা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ব্রিকসের সম্প্রসারণও নতুন প্রশ্নের জš§ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ আলজেরিয়া ও মিসরের মতো দেশগুলোও এখন ব্রিকসে যোগ দিতে চাইছে। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘ব্রিকস নীতি’ তৈরি করা উচিত, যা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন করে কল্পনা করতে সাহায্য করতে পারে। সেই ব্রিকস নীতি নিশ্চিত করতে পারবে যে যুক্তরাষ্ট্র এখন আর কোনো একক দেশের খবরদারির বিশ্বে নয়, বরং একটি বহুমুখী বিশ্বে অবস্থান করছে। ব্রিকসের অর্জন খুব বেশি নয়। সবচেয়ে বড় অর্জন একটি ব্যাংক। ২০১৫ সালে গঠিত হয় নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এই ব্যাংক এখন পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক শুধু ২০২২ সালে দিয়েছে ১০ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঋণ। জোহানেসবার্গ সম্মেলনে যেসব বিষয় আলোচিত হয়েছে বলে জানা গেছে, বৈশ্বিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফটের বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলা তার একটি। ডলারবিহীন আর্থিক ব্যবস্থা ও ব্রিকস পে নামে একটি লেনদেনব্যবস্থা গড়ে তোলা, নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করে বাণিজ্য করা এবং একসময় নিজেদের একটি একক মুদ্রা চালু করাÑএসবই আছে ব্রিকসের অভিলাষের তালিকায়। তবে ব্রিকস জোট সত্যিকার অর্থে একদিকে হেলে রয়েছে। চীনের অর্থনীতির আকার এখন ১৯ ট্রিলিয়ন বা ১৯ লাখ কোটি ডলার, যা ব্রাজিলের তুলনায় ৫০ গুণ বড়। পৃথিবীর বেশির ভাগ বড় অর্থনীতির সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্য চীনের পক্ষে থাকলেও রাশিয়া, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সাম্প্রতিক বাণিজ্য ভারসাম্য দেশটির বিপক্ষে। ব্যতিক্রম ভারত। ২০২২ সালে ভারত থেকে আমদানির তুলনায় সে দেশে চীনের রপ্তানি ১০ হাজার কোটি ডলার বেশি ছিল। বাণিজ্য সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিকসের অন্যতম ঘোষিত নীতি হলো একটি বিকল্প বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এটা বেশি করে চাইছে চীন ও রাশিয়া। ব্রাজিলের বামপন্থি প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দ্য সিলভাও তাতে সমর্থন জানাচ্ছেন, সঙ্গে চাইছেন ডলারের বাইরে একটি লেনদেনব্যবস্থা চালু করতে।

সাম্প্রতিক ডলার-সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অনেক দেশই কঠিন সময় পার করছে। এদের অনেকেই ডলারের একক আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। অন্যদিকে বিদেশে রাখা রাশিয়ার সম্পদ জব্দ হওয়ার কারণে চীন কিংবা কর্তৃত্ববাদী কিছু দেশ উদ্বিগ্ন। চীনের ইউয়ান আর ভারতের রুপিতে কিছু বাণিজ্য ইদানীং শুরু হয়েছে। তবে সমস্যা হলো, ইউয়ান কিংবা রুপি কোনোটিই পুরোপুরি রূপান্তরযোগ্য নয়। আর ভারত ইউয়ান ব্যবহারে খুব একটা আগ্রহী নয়। তারা চায় রুপির আন্তর্জাতিকীকরণ। সে লক্ষ্যে দেশটি সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য শুরু করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত পাঁচ বিকাশমান অর্থনীতির জোট ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভা ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্য নিজস্ব মুদ্রা চালুর আহ্বান জানিয়েছেন। তার যুক্তি, ডলারের বিনিময় হার সব সময়ই ওঠানামা করে, তাই ব্রিকসের সদস্য দেশগুলো একটি নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করতে পারে। তবে ব্রিকসের মতো একটি জোটের জন্য মুদ্রা চালু করা খুব সহজ বিষয় নয়। এ ধরনের প্রকল্পে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে, সে বিষয়ে আলো ফেলেছেন ব্রিকসের কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদরা। বিশেষ করে, ব্রিকসভুক্ত ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পার্থক্যের প্রেক্ষাপটে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বিশ্বাস করেন না যে ডলার ব্যবহার করে না, এমন দেশগুলোকে বাণিজ্যে ডলার ব্যবহারে বাধ্য করা উচিত। এ ছাড়া তিনি দক্ষিণ আমেরিকার মারকোসুর ব্লকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও অভিন্ন মুদ্রা ব্যবহারের কথা বলেন। ব্রিকস সম্মেলনের প্লেনারি অধিবেশনে তিনি বলেন, ব্রিকসের মুদ্রা থাকলে আমাদের যেমন অর্থ পরিশোধের নানা পথ তৈরি হবে, তেমনি আমাদের অনিশ্চয়তাও কমবে।

ব্রিকসের মুদ্রা চালু করার বিষয়টি ‘নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক প্রকল্প’। দক্ষিণ আফ্রিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর লেসেৎজা কগাইনগো জুলাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার এক রেডিও স্টেশনকে এ কথা বলেছিলেন। কগাইনগো আরও বলেছিলেন, অভিন্ন মুদ্রা চালু করতে হলে ব্যাংকিং ইউনিয়ন প্রয়োজন হবে, সেই সঙ্গে প্রয়োজন রাজস্ব ইউনিয়ন ও সামষ্টিক অর্থনীতির একীভবন। এ ছাড়া আরও কিছু প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। যেমন ব্রিকস মুদ্রা চালু হওয়ার পর কোনো দেশ যদি নিয়ম লঙ্ঘন করে, তাহলে তাদের পথে আনার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ছাড়া প্রয়োজন হবে অভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ঠিক করতে হবে সেই ব্যাংক কোথায় থাকবে। এর বাইরে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যকার বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা থাকার কারণেও অভিন্ন মুদ্রা চালু করা কঠিন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ব্রিকসের সব দেশের মূল বাণিজ্য অংশীদার হচ্ছে চীন, কিন্তু বাকি দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য খুবই কম। গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়া হয়ে যায়। রাশ টানতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভসহ অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে এবং পরিণামে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যায়। সে কারণে অনেক দেশ এখন ডলার পাশ কাটিয়ে ভিন্ন মুদ্রায় বাণিজ্যের চেষ্টা করছে। এ ছাড়া যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। সে কারণেও অনেকের মনেই এই প্রত্যয় হয় যে বিশ্বের অনেক দেশ, বিশেষ করে, যারা পশ্চিমাদের মিত্র নয়, তারা ডলার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এ বিষয়ে সম্মেলনে পুতিন বলেছেন, ডি-ডলারাইজেশন প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে, এটাকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুসারে, ২০২২ সালে বৈশ্বিক রিজার্ভে ডলারের পরিমাণ ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে এসেছে, যা ৫৮ শতাংশ। বিনিময় হার সমন্বয়ের পর দেখা যায়, তা কার্যত ৪৭ শতাংশ। এরপরও বিশ্ব বাণিজ্যে এখনও ডলারে আধিপত্য চলছে। ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টসের তথ্যানুসারে, বিশ্বে যত বিদেশি মুদ্রা লেনদেন হয়, তার ৯০ শতাংশ এখনও ডলারে হয়। ডি-ডলারাইজেশনের প্রক্রিয়াকে যদি সত্যিই এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে বিশ্বের অগণিত আমদানিকারক, রপ্তানিকারক, ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতাদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রা ব্যবহার করবে।

                অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক