Print Date & Time : 7 August 2025 Thursday 9:21 pm

ডলার সংকটের খড়্গ ওষুধ শিল্পে

বীর সাহাবী:বর্তমানে ওষুধ তৈরিতে বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে সারা বছর যে পরিমাণ ওষুধ প্রয়োজন হয় তার প্রায় ৯৭ শতাংশই এখন দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত হয়। তবে ওষুধের কাঁচামাল বেশিরভাগই আমদানি করে আনতে হয়। বর্তমানে পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণে ওষুধের কাঁচামাল বা অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট (এপিআই) বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট ডলার সংকটের কারণে এপিআই আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এতে করে জীবন রক্ষাকারী অনেক ওষুধের উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দু-এক মাসের মধ্যে দেশের বাজারে জরুরি অনেক ওষুধের সরবরাহ সংকট দেখা দেবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বাজারে ওষুধের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। বেশকিছু ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই ফার্মেসিগুলোতে। এমন পরিস্থিতিতে এ খাত নিয়ে অনুসন্ধান করেছে শেয়ার বিজ। দেশের শীর্ষ ২০টি ওষুধ কোম্পানির বেশ কয়েকটির দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করেছেন এই প্রতিবেদক। আলাপে তারা ওষুধের কাঁচামাল আমদানির পেছনে নানা সংকটের বিষয় তুলে ধরেন। তবে অধিকাংশ কোম্পানির কর্তা ব্যক্তিরা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

স্বনামধন্য একটি ওষুধ কোম্পানির চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে জানান, তার কোম্পানি কাঁচামাল আমদানির জন্য ৩৬টি এলসি খোলার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকে কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে ওইসব ব্যাংক ঋণপত্রগুলো চালু করতে পারছে না। এই উদ্যোক্তা জানান, তার কাছে যে পরিমাণ কাঁচামাল আছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াই মাস উৎপাদন চালু রাখা যাবে। ধারাবাহিক উৎপাদন কার্যক্রম চালু রাখতে হলে জরুরি ভিত্তিতে এলসি খোলা প্রয়োজন। কারণ একটি এলসি খোলার পর রাতারাতি পণ্য দেশে চলে আসবে না। এক্ষেত্রে প্রায় দুই মাস সময় (লিড টাইম) প্রয়োজন। কাজেই ওষুধের এলসিগুলো যদি জরুরি ভিত্তিতে খোলা না হয়, তাহলে আগস্ট মাস নাগাদ দেশের বাজারে জীবন রক্ষাকারী অনেক ওষুধের সংকট দেখা দেবে বলে ওই উদ্যোক্তা জানান।

কেবল ওই উদ্যোক্তাই নন, শীর্ষস্থানীয় আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে একই চিত্র পাওয়া গেছে। সবার একই অভিযোগ যে, টাকা নিয়ে ব্যাংকে ধরনা দিয়েও এলসি খোলা যাচ্ছে না। অধিকাংশের বক্তব্য হলোÑ সময়মতো কাঁচামাল আমদানি করতে না পারলে জীবন রক্ষাকারী অনেক জরুরি ওষুধ উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। ফলে নিকট ভবিষ্যতে ওষুধ ব্যবহারকারীদের পাশাপাশি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও হুমকির মুখে পড়বে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান নির্বাহী কর্মকতা (সিইও) মোহাম্মদ হালিমুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এলসি খুলতে সব ব্যাংকে প্রব্লেম (সমস্যা) হচ্ছে। তাদের কাছে পর্যাপ্ত ডলার নেই। বার বার তাদের কাছে ধরনা দিতে হচ্ছে। এই সমস্যা অতিদ্রুত সমাধান না হলে কয়েক মাসের মধ্যে ওষুধের সরবরাহ সংকট তৈরি হতে পারে।’

এদিকে গত বছরের আগস্টের পর থেকে হু হু করে বাড়ছে ডলারের দাম। ৮৬ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে এক ডলারের বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ১০৭ থেকে ১১০ টাকায়। ততে এলসি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আরও চার-পাঁচ টাকা বেশি গুনতে হয়।

সে ক্ষেত্রে এলসি খোলার জন্য একজন উদ্যোক্তাকে ব্যাংক ভেদে এক ডলারের বিপরীতে ১১২ থেকে ১১৫ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে। উদ্যোক্তারা এ বাড়তি অর্থ দিতেও প্রস্তুত। এমনকি অনেকে নগদ টাকা নিয়ে ব্যাংকের কাছে ধরনা দিচ্ছেন এলসি খোলার জন্য। তা সত্ত্বেও ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে না। এমন ওষুধ শিল্পে নানামুখী সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আমদানি খরচও বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে ওষুধের দাম ও সরবরাহের ওপর।

জানতে চাইলে দ্য একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান সিনহা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এলসি খুলতে আগের থেকে এখন সময় একটু বেশি লাগছে। তা ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে।’ ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন তো বাজারে সব পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী। তবে ওষুধ যেহেতু সাধারণ মানুষের কাজে লাগে বেশি, তাই সরকার এটির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। ওষুধ খাতের প্রতি সরকারের একটা নজরদারি সব সময়ই আছে।’

এদিকে চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ উৎপাদন করতে না পারায় দেশে সরবরাহের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানিও কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের গত ১১ মাসে (জুলাই-মে) গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ওষুধ রপ্তানি কমেছে ৮ শতাংশ। পাশাপাশি এই ১১ মাসে যে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, তার থেকেও সাড়ে ২২ শতাংশ ওষুধ কম রপ্তানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ কোটি ডলার। আর ১১ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২০ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। এর বিপরীতে অর্থবছরের ১১ মাসে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ১৬ কোটি ১১ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতটি থেকে রপ্তানি আয় এসেছিল ১৭ কোটি ৫১ লাখ ডলার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক মাসে ওষুধের কাঁচামাল এবং এ শিল্পের মেশিনারিজ আমদানি হ্রাস হয়েছে। যেটুকু আমদানি করা যাচ্ছে, তাতেও খরচ পড়ছে বেশি। উৎসে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মান অব্যাহতভাবে কমে যাওয়ায় খরচ বাড়ছে। পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে বৈকি। পাশাপাশি শিল্পে ব্যবহƒত গ্যাস-বিদ্যুতের দাম এরই মধ্যে দফায় দফায় বেড়েছে।

সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ছোট বড় অনেক ফার্মেসিতে ঘুরে দেখা গেছে, ফ্লুক্লক্সাসিলিন ৫০০ এমজি প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা ২৮ পয়সা, যা মাস দুয়েক আগেও ছিল ৪০ টাকা, সেফিক্সিম ৪০০ এমজি ৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা, প্যারাসিটামল ৫০০ এমজি প্রতি পিস ১ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ টাকা ২০ পয়সা, ওমেপ্রাজল ২০ এমজি ৬ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা ৫০ পয়সা, ডমপেরিডন ১০ এমজি ৩ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪ টাকায়, ক্যালসিয়াম+ভিটামিন ডি-৩ ৫০০ এমজি+২০০ আইইউ ১২ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৭ টাকা, মন্টিলুকাস্ট ১০ এমজি ১৫ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমাশয়ে বহুল ব্যবহƒত মেট্রোনিডাজল ৪০০ এমজির দাম মাস দুয়েক আগেও দেড় টাকা পিস ছিল, বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ২ টাকায়। অনেক ব্র্যান্ডের এই ওষুধের আবার সরবরাহও কমে গেছে। সর্দি কাশিতে ব্যবহƒত সেটিরিজিন ১০ এমজি আড়াই টাকা ছিল, তা এখন বেড়ে ৩ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

সাধারণ ওষুধের দাম বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে ক্যান্সারের কেমোথেরাপির দাম। সরেজমিনে দেখা গেছে, দুই মাস আগেও একটি শীর্ষ কোম্পানির কেমোথেরাপির দাম ছিল ৯ হাজার টাকা, যা বর্তমানে এক লাফে আড়াই হাজার টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১ হাজার ৫০০ টাকা।

বাংলামটরের পদ্মা ফার্মেসির ব্যবস্থাপক জয়নুল আবেদীন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রায় সব ধরনের ওষুধের দামই আগের তুলনায় বেড়েছে। গত দুই মাসে এসব ওষুধের দাম বাড়ে বেশি। এমন কোনো ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল নেই যেটার দাম ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়েনি। এর পাশাপাশি ডাক্তারি পরামর্শে শরীরের সুস্থতার জন্য ব্যবহƒত বিভিন্ন বিদেশি পণ্যের দামও বেড়েছে বেশ। কোম্পানিগুলো দাম বাড়ায়, আমাদের সেই দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে ওষুধের দাম বাড়ায় আমাদের বিক্রি আগের থেকে অনেকটা কমেছে।

ধানমন্ডি এস আর ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাতে ওষুধ কিনতে আসা ইমন চৌধুরী নামে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ওষুধের দাম যে হারে বেড়েছে, এতে মনে হয় বড় ধরনের অসুখ হলেও ওষুধ না খেয়েই থাকতে হবে। নিত্যপণ্যের পাশাপাশি যদি জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দামও এভাবে বেড়ে যায় তাহলে কীভাবে আমরা বাঁচব?

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নুরুল আলাম বলেন, গত কয়েক মাসে সাধারণ রোগের বিভিন্ন ওষুধেরও দামও দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে কর বা অন্য ফি ধরা হলেও ক্যান্সারের মতো অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের বেলায় সব ধরনের কর মওকুফ ও রেয়াতের সুযোগ করা আছে। তাই দাম বাড়ানোর কারণ স্পষ্ট নয়। অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানো হলে ব্যবস্থা হবে।