ডলার সংকট কাটছে না প্রয়োজন রেমিট্যান্স, রপ্তানি বৃদ্ধিও কৃষি খাতের উন্নয়ন

মো. মাঈন উদ্দীন: ডলার সংকট দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত করছে। শিল্প খাত ছাড়াও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানসহ সার্বিক উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাচ্ছে না। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। ২০২২ সালে এক ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা, এখন তার দাম বেড়ে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা ছাড়িয়ে গেছে। দাম বেড়েছে ২৫ টাকা ৫০ পয়সা। এ বৃদ্ধির হার ৩০ শতাংশ। ডলারের ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে পণ্য ও জ্বালানিসহ অন্যান্য সেবার মূল্যবৃদ্ধির চাপ জনগণকে ভোগ করতে হচ্ছে। ডলারের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে আমদানি পণ্যের দামও বেড়ে গেছে। ফলে বিনিয়োগ খুব একটি বাড়ছে না। কর্মসংস্থানও সংকুচিত হচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে চলতি অর্থবছরটিও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হবে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন আক্রমণ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম হু-হু করে বাড়তে থাকে। আমদানি ব্যয়ও বাড়তে থাকে। জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানিতে ২৫ শতাংশ এলসির মার্জিন আরোপ করে। পরে ধাপে ধাপে তা বাড়িয়ে শতভাগ করা হয়। কেবল খাদ্য, জ্বালানি, কৃষি, শিল্প, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও জীবনরক্ষাকারী ওষুধ আমদানি ছাড়া সব পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, যা এখনও অব্যহত রয়েছে। আমদানি কম হওয়ার ফলে অর্থনীতিতে শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ বিঘœ হচ্ছে, জ্বালানি/বিদ্যুৎ খাতে সমস্যা হচ্ছে, মূলধনি যন্ত্রপাতির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বাজারের ওপর এর প্রভাব ক্রমান্বয়ে তীব্র হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা ২৫-৩০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য নানা সংকটে পতিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে দেখা যায়, একসময় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। এ রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ক্রমাগতভাবে ৪০ বিলিয়ন ডলার, তারপর ৪২ বিলিয়ন ডলার এবং একপর্যায়ে বেড়ে হয় ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এ রিজার্ভের বৃদ্ধিতে একশ্রেণির রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীদের মাথা গরম হয়ে যায়। তারা উন্নয়নের কথা বলে রিজার্ভ নিয়ে ব্যবসা শুরুর পরামর্শ দিলেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে রপ্তানিকারকদের রিজার্ভের ডলার থেকে সাত-আট বিলিয়ন ডলার দিয়ে দেয়া হয়। বিদেশি রাষ্ট্রকেও (শ্রীলঙ্কা) ডলার দেয়া হয়। এদিকে কভিড মহামারি উত্তরণের পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আমদানির নামে কেউ কেউ অর্থ পাচারও করে। রপ্তানিতে ভাটা পড়ে। রেমিট্যান্সও হ্রাস পেতে থাকে। হুন্ডির ব্যাপকতার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণও হ্রাস পেতে থাকে। ফলে দেশে রিজার্ভের ঘাটতি শুরু হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাত পোশাক রপ্তানিসহ রপ্তানি খাত ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিও নগণ্য। অথচ ডলারের মাধ্যমে ব্যয় হিসাব অনেক বড় হচ্ছে। এর প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় ঘাটতি হচ্ছে। এই ঘাটতির কারণে ডলারের দামও বাড়ছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেড়েছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে কমেছিল ১৫ শতাংশেরও বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল দুই হাজার ১০৩ কোটি ডলার। ২০২২ সালে এসেছিল দুই হাজার ১৬১ কোটি ডলার। এক বছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৫৮ কোটি ডলার। রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিও কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার অনুদানের ক্ষেত্রে ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-মে সময়ে নিট বৈদেশিক অনুদান বেড়েছিল ৫৭ শতাংশ। একই সময়ে এফডিআই কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই সময়ে এফডিআই (সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ) এসেছিল ১৭৬ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছে ১৬৪ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি কমানোর ওপর জোর দিলেও আমদানির দেনা ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের যে সংস্থান দরকার তা হচ্ছে না। বর্তমানে গড়ে প্রতি মাসে ৭০০ কোটি ডলারের আয় হচ্ছে। এর বিপরীতে তাৎক্ষণিক আমদানি ডলার মেটাতে হচ্ছে ৬৫০ কোটি ডলার। বকেয়া ঋণ পরিশোধের ব্যয় হচ্ছে কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার। এই হিসাবে মাসে ঘাটতি হচ্ছে ৫০ কোটি ডলার। এছাড়া বিদেশে বিভিন্ন সভা, রয়্যালিটি, মুনাফা প্রত্যাবাসনসহ সব মিলিয়ে আরও বেশ কিছু ডলার খরচ হচ্ছে। এতে প্রতিমাসে ডলারের ঘাটতি হচ্ছে। আগে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে স্বল্পমেয়াদি দায় মেটানো হতো। এখন ঋণ গ্রহণের পরিমাণ কমে গেছে। ফলে ডলার সংকট আরও প্রকট  হচ্ছে। রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য তৈরি পোশাকের পাশাপাশি যদি কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি বাড়ানো যায়, তাহলে এই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব। বৈশ্বিক তৈরি পোশাকের সরবরাহকরী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয় হলেও বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা তুলনামূলকভাবে দাম পাচ্ছেন অনেক কম। বিশ্বব্যাপী গত বছর পোশাক বাজারের আকার ছিল ৫৭৬ বিলিয়ন বা ৫৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে চার হাজার ৫০০ কোটি ডলারের পোশাক সরবরাহ করেছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে পোশাক রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পরের অবস্থানের রয়েছে ভিয়েতনাম, তুরস্ক, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের অধীন অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (ওটিএক্সএ) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সালে দেশটিতে বাংলাদেশের  সরবরাহ করা পোশাকের মূল্য ছিল ৯৭৪ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলার, যেখানে প্রতি বর্গমিটারের জন্য রপ্তানিকারকেরা দাম পেয়েছেন তিন ডলার এক সেন্ট। অথচ ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও ভিয়েতনাম প্রতিবর্গ মিটারের জন্য গড়ে চার ডলারেরও বেশি পায়। রপ্তানিকৃত পণ্যে দাম বেশি পেতে হলে প্রয়োজন উৎপাদিত পণ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে আসা, পোশাকে কৃত্রিম তন্তু ব্যবহার করা। রপ্তানিকারকেরা তাদের পোশাক রপ্তানিতে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনে নানা বৈচিত্র্য নিয়ে এলে দামও বেশি পাবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রাও বেশি আহরিত হবে।

ডলারের রিজার্ভ বাড়াতে হলে আমাদের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করতে হবে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য প্রশিক্ষিত জনশক্তি বিদেশে পাঠাতে হবে। কূটনৈতিক তৎপরতা ও আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক বাড়ানোর মাধ্যমে আমাদের যে ব্যাপক বেকার, শিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত জনবল রয়েছে, তা বিদেশে পাঠাতে হবে। তারাই আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভুমিকা রেখে যাচ্ছে এবং ভবিষতেও রেখে যাবে। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ বা বিনিয়োগ পাওয়ার মাধ্যমেও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বাড়ানের যেতে পারে।

এদিকে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহেও শ্লথ গতি দেখা দিয়েছে। জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিট্যান্স বাড়ছে না। কারণ হুন্ডিওয়ালাদের খপ্পরে পড়ছে রেমিট্যান্স ব্যবসা। হুন্ডিওয়ালারা অবৈধ ব্যবসায় অর্থ জোগানের উদ্দেশ্যে বিদেশে ডলার সংগ্রহ করে বেশি দামে। ঘরে ঘরে মুহূর্তের মধ্যে টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে প্রবাসীরা বেশি টাকা পাচ্ছে। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। কিন্তু ইদানীং বৈদেশিক ঋণের বা বিনিয়োগের তেমন ভালো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাই রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংকসমূহকে প্রবাসীদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের রপ্তানির বাজার হচ্ছে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশে পোশাক রপ্তানির পাশাপাশি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, চা, হিমায়িত চিংড়ি, বিভিন্ন ফল ও সবজি, আলু, কপিসহ কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হলে কৃষি খাতের সমস্যাগুলো দূর করে দক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি উৎপাদন জোরদার করতে হবে।

খাদ্য নিরাপত্তা ও দেশের মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় রাখতে হলে কৃষি উন্নয়ন ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। পুষ্টির অভাবে বাংলাদেশের পাঁচ বছর বয়সী ৩৯ লাখ শিশু খর্বাকার। তাই দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখা বড় চ্যালেঞ্জ। তাই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষিতে প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটানোর জন্য সরকারকে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অনাবাদি জমিকে কৃষি উৎপাদনের কাজে লাগতে হবে। পাশাপাশি মৎস্য ও পশু পালন জোরদার করার জন্য যুবসমাজকে কাজে লাগাতে হবে। চাকরির পেছনে যুবকদের না ঘুরে ধান উৎপাদন, সবজি ও ফল উৎপাদন এবং মৎস্য খামার স্থাপনসহ হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর খামার করে আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের যে পরিকল্পনা রয়েছে তা জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে কৃষি থেকে শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ সহজ হবে। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ উন্নত করে বিদেশেও রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবইতে দেশপ্রেম বৃদ্ধি ও দেশের সম্পদ সুরক্ষা, অপচয় রোধ করা ও নৈতিকতা, মানবিকতা ও সততার চর্চা-বিষয়ক পাঠ্য সংযুক্ত করা উচিত। আমাদের যে ব্যাপক জনবল রয়েছে, তারাই আমাদের বড় সম্পদ। এই ব্যাপক জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে শুধু ডলার সংকট নয়, দেশের সব আর্থসামাজিক সমস্যারও উত্তরণ ঘটানো সম্ভব।

                ব্যাংকার, কলাম লেখক