জাতীয় ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস আজ

ডায়াবেটিস সেবা নিতে আর দেরি নয়

মো. আরাফাত রহমান;ডায়াবেটিস একটি হরমোন-সংশ্লিষ্ট রোগ। দেহযন্ত্র অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে অথবা শরীর যদি উৎপন্ন ইনসুলিন ব্যবহারে ব্যর্থ হয়, তাহলে যে রোগ হয় তা হলো ডায়াবেটিস (বহুমূত্র রোগ)। তখন রক্তে চিনি বা শকর্রার উপস্থিতিজনিত অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। ইনসুলিনের ঘাটতিই হলো এ রোগের মূল কথা। অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন ইনসুলিন, যার সহায়তায় দেহের কোষগুলো রক্ত থেকে গ্লুকোজ নিতে সমর্থ হয় এবং একে শক্তির জন্য ব্যবহার করতে পারে। ইনসুলিন উৎপাদন বা ইনসুলিনের কাজ করার ক্ষমতার যেকোনো একটি বা দুটোই যদি না হয়, তাহলে রক্তে বাড়তে থাকে গ্লুকোজ। আর একে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ঘটে নানা রকম জটিলতা, দেহের টিস্যু ও যন্ত্র বিকল হতে থাকে।

১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ড. মো. ইব্রাহিমের উদ্যোগে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই এই দিনটিকে ডায়াবেটিস সচেতনতা তৈরিতে উপজীব্য করা হয়। এছাড়া প্রতি বছরই ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয়। এদিন বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেনটিং জš§ নিয়েছিলেন এবং তিনি বিজ্ঞানী চার্লস বেস্টের সঙ্গে একত্রে ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন। লক্ষ্য হলোÑ পৃথিবীতে কোনো শিশুই যেন ডায়াবেটিসে মারা না যায়। ডায়াবেটিসের মতো ক্রনিক রোগ ব্যক্তি, পরিবার, দেশ, এমনকি সারা পৃথিবীর জন্য গুরুতর ঝুঁকি বহন করে-এ সত্য জাতিসংঘ অনুধাবন করে ২০০৬ সালে একে জাতিসংঘ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পৃথিবীতে প্রায় ৪৬৫ মিলিয়ন লোক ডায়াবেটিস নিয়ে জীবন যাপন করছে।

মানুষের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ সাধারণত ৩.৩ থেকে ৬.৯ মিলি.মোল/লি আর খাবার পর <৭.৮ মিলি.মোল/লি। কিন্তু যদি গ্লুকোজের পরিমাণ অভুক্ত অবস্থায় ৭ মিলি.মোল/লি আর খাবার পর >১১ মিলি.মোল/লি পাওয়া যায়, তবে তার ডায়াবেটিস আছে বলে ধরে নেয়া হয়। বহুমূত্র রোগ বা ডায়াবেটিস বললে সাধারাণত ডায়াবেটিস মেলিটাস বোঝায়। তবে ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস নামে আরেকটি রোগ আছে যাতে মূত্র উৎপাদন বেশি হয় কিন্তু তা অউঐ বা অ্যান্টি ডাইইউরেটিক হরমোন নামে অন্য একটি হরমোনের উৎপাদনের অভাব বা ক্রিয়ার অভাবে হয়ে থাকে এবং মূত্রাধিক্য এবং তার জন্য অতিতৃষ্ণা এই দুটি উপসর্গের মিল ছাড়া এই রোগটির সঙ্গে ডায়াবেটিস মেলিটাসের কোনো সম্পর্ক নেই। এ দুটির মধ্যে ডায়াবেটিস মেলিটাসের প্রকোপ অনেক বেশি। ডায়াবেটিস মেলিটাস আবার দুই রকম হতে পারে। যথা: টাইপ-১ বা ইনস্যুলিন নির্ভরশীল এবং টাইপ-২ বা ইনস্যুলিন নিরপেক্ষ ডায়াবেটিস।

টাইপ-১ ডায়াবেটিস হলো অটোইমিউন রোগ। এ রোগে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণকারী কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। তাই যাদের টাইপ-১ হয়, এদের দেহে ইনসুলিন উৎপাদিত হয় খুবই কম। এ জন্য রোগীকে বেঁচে থাকার জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন বা ইনসুলিন পাম্প নিতে হয়। শিশু ও তরুণদের মধ্যে এ ধরনের বহুমূত্র হয় বেশি। ১০-৩০ বছরের মধ্যে দেখা দেয়। ইহা মূলত জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। এর জন্য দায়ী হলো ঐখঅউজ ৩ এবং ঐখঅউজ ৪ নামক দুটি জিন । টাইপ-১ কে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়, টাইপ-১-এ: অটোইমিউনিটির জন্য বিটা কোষের ধ্বংসের কারণে এই টাইপ-১-এ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। টাইপ-১-বি: এটিও বিটা কোষের ধ্বংসের কারণে হয়ে থাকে, কিন্তু এর সঠিক কারণ জানা যায়নি।

টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগের পেছনে থাকে মূলত ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স’। টাইপ-২ রোগীরা তাদের শরীরে যে ইনসুলিন উৎপন্ন হয়, তাকে ব্যবহার করতে পারে না। ব্যায়াম ও খাদ্যবিধির সাহায্যে একে প্রথমে মোকাবিলা করা হয়। তবে অনেক সময় প্রয়োজন হয় মুখে খাওয়ার ওষুধ, এমনকি ইনসুলিন ইনজেকশন। ৪০ বছর বা তারপরে এ ধরনের ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় পানীয় টাইপ-২ এর ঝুঁকি বাড়ায়। খাবারে চর্বির ধরনও গুরুত্বপূর্ণ; স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্রান্স-ফ্যাটি এসিড ঝুঁকি বাড়ায় পক্ষান্তরে পলি-আনস্যাচুরেটেড ও মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট ঝুঁকি কমায়।

অত্যধিক পরিমাণ সাদা ভাত খাওয়াও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। শারীরিক পরিশ্রম না করাও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের অন্যতম একটা কারণ। বিশ্বজুড়ে ৪৬৫ মিলিয়ন ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ শতাংশের বেশি হলো টাইপ-২ ডায়াবেটিস। দুই ধরনের ডায়াবেটিসই গুরুতর এবং হতে পারে শিশু ও তরুণদেরও। এ জন্য ডায়াবেটিসের বিপদ-চিহ্নগুলো জানা খুবই প্রয়োজন। ‘মৃদু ডায়াবেটিস’ বলে কিন্তু কিছু নেই। নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় তৃতীয় এক প্রকার ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। এটা গ্যাস্টেশনাল ডায়াবেটিস নামেও পরিচিত। ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬১/২২৫ নম্বর ঘোষণায় ডায়াবেটিসকে দীর্ঘমেয়াদি, অবক্ষয়ী ও ব্যয়বহুল ব্যাধি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা মানবদেহে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।

ডায়াবেটিসের সাধারণ লক্ষণাদির মধ্যে রয়েছে, ঘন ঘন প্রস্রাব, যার কারণে এ রোগটির নাম বহুমূত্র রোগ, অধিক তৃষ্ণা এবং মুখ শুকিয়ে যাওয়া, অতিশয় দুর্বলতা, সার্বক্ষণিক ক্ষুধা, স্বল্প সময়ে দেহের ওজন হ্রাস, চোখে ঝাপসা দেখা, ঘন ঘন সংক্রমণ ইত্যাদি। ডায়াবেটিসের অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন: বেশি পরিমাণে জাঙ্কফুড খাওয়ার ফলে শরীরে ক্যালোরি এবং ফ্যাটের পরিমাণ বেড়ে যায়। যার কারণে শরীরের ইনসুলিনে চিনির মাত্রা বেড়ে যা, জিনগত রোগের কারণে ডায়াবেটিস হতে পারে, ডায়াবেটিস শরীরের অতিরিক্ত ওজন এবং ওজন বৃদ্ধির কারণে ঘটতে পারে, প্রতিদিনের শারীরিক ক্রিয়াকলাপ অনুশীলন না করায় ডায়াবেটিস হতে পারে, বেশি চাপে থাকার কারণে ডায়াবেটিস সমস্যা হয়ে যায়, যদি কোনো ব্যক্তি অতিরিক্ত পরিমাণে ধূমপান করে তার ফলস্বরূপ তার ডায়াবেটিস হতে পারে, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ভুল ওষুধ সেবনের কারণে একজন ব্যক্তির ডায়াবেটিস হতে পারে। বলা যেতে পারে, ডায়াবেটিস হলো কোনো ব্যক্তির অতিরিক্ত চা, কোল্ড ড্রিঙ্কস এবং মিষ্টি জাতীয় খাবার গ্রহণের ফলস্বরূপ।

অতিরিক্ত মেদ এ রোগের অন্যতম কারণ। উপসর্গহীনতা বা অসচেতনতার কারণে চিকিৎসার অভাবে ডায়াবেটিস হতে পারে। কিডনি বা বৃক্কের অক্ষমতার অন্যতম মূল কারণ ডায়াবেটিস। অন্ধত্ব বা দৃষ্টিবিচ্যুতির অন্যতম মূল কারণ ডায়াবেটিস। এছাড়া বিনা দুর্ঘটনায় অঙ্গচ্ছেদের অন্যতম মূল কারণও ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় চিকিয়ৎসক চিনির স্তর নিয়ন্ত্রণে রাখতে রোগীদের যথাযথ খাওয়া এবং ব্যায়াম, যোগের মতো শারীরিক ক্রিয়াকলাপ করার পরামর্শ দেন। ডায়াবেটিস সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিকিৎসকরা প্রথমে রোগীর চিনির স্তর পরীক্ষা করেন। এই ব্লাড সুগার টেস্ট দুটি উপায়ে করা হয়। প্রথম রক্তে চিনির পরীক্ষা খালি পেটে এবং দ্বিতীয়বার রক্তে শর্করার পরীক্ষা খাওয়ার পরে করা হয়।

পরীক্ষার পরে, কিছু ওষুধ, যেমন: মেটফর্মিন, চিনির স্তর নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দেয়া হয়। এটি কেবল ডায়াবেটিস টাইপ ২ রোগীদের দেয়া হয়। এ ড্রাগ ইনসুলিন উৎপাদন উৎসাহিত করে। শরীরকে ইনসুলিন আরও ভালোভাবে ব্যবহার করতে সহায়তা করে। টাইপ ১ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের রোগীদের চোখের রেটিনা, ছানি ইত্যাদি একবারে পরীক্ষা করা উচিত। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে কালো জাম খাওয়া উচিত। ব্ল্যাকবেরি তে অনেক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। যা ইনসুলিন তৈরিতে সহায়তা করে। যার কারণে রক্তে সুগার স্বাভাবিক পর্যায়ে থেকে যায়।

গুড়ের ৮ থেকে ১০টি টুকরা পিষে একটি চাটনি তৈরি করে তারপরে এটি এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে সারারাত রেখে দিতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে তা পান করতে পারলে কাজে দেবে। হিবিস্কাসের পাতায় উচ্চ পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড থাকে। এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খুব কার্যকর প্রমাণ করে। ড্রামস্টিক পাতার রস ডায়াবেটিসে প্যানাসিয়ার মতো কাজ করে। ড্রামস্টিক পাতায় প্রচুর পরিমাণে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড থাকে। যা চিনির স্তর নিয়ন্ত্রণ এবং ইনসুলিন বাড়ায়, এর ফলে প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি নিম পাতা চিবানো উচিত। নিমের উপস্থিত অ্যান্টিভাইরাল গুণ দেহে চিনির স্তর নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।

ডায়াবেটিস রোগীদের দৈনিক ব্যায়াম, যোগব্যায়ামের মতো শারীরিক ক্রিয়াকলাপ করা উচিত। যোগব্যায়ামের আসন করা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী। ডায়াবেটিস রোগীদের সর্বদা তাদের পায়ে আঘাত এড়ানো উচিত। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত। অতিরিক্ত তেল এবং মশলা এড়িয়ে চলা এবং প্রতিদিন পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসা হলো ইনসুলিন, অ্যান্টিডায়াবেটিক মুখে খাওয়ার ওষুধ, জীবনধারার পরিবর্তন, নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্য গ্রহণে সচেতনতা এবং অসুখ সম্বন্ধে রোগীর প্রয়োজনীয় ও সঠিক ধারণা।

সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ

সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

arafatrahman373@gmail.com