ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানুষ কি নিরাপদ?

রাশেদ ইসলাম: কোনো জাতির ভাষাকে ধ্বংস করলে সেই জাতির ধ্বংস অনিবার্য। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের আন্দোলনের ধরন ছিল জাতি বাঁচানোর আন্দোলন। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র কয়েক মাস পরই যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রস্তাব দেন, তখনই ওই সভা থেকেই ‘না, না’ বলে প্রতিবাদ করা হয়েছিল। ফলে ১৯৫২ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিজের মাতৃভাষা রক্ষার জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত দেন সালাম, রফিক, জব্বারসহ অসংখ্য বীর সৈনিক। কলম হাতে নিয়ে বিদ্রোহ করেন কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, নাট্যকারসহ দেশের বুদ্ধিজীবীরা। লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষা, যে ভাষায় আমরা প্রাণ খুলে কথা বলতে পারব, রাজপথে অধিকারের কথা বলতে পারব। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পেরিয়েছে এবং স্বাধীন দেশ পেয়েছি, সংবিধান বাংলায় রচনা হয়েছে, তবে কিছু কিছু বিষয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটুকু রয়েছে? সময়ের পরির্বতনে সঙ্গে মানুষের মত প্রকাশের পদ্ধতিরও পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে মত প্রকাশের অন্যতম যোগাযোগ মাধ্যম হলো ফেসবুক। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে শেরেবাংলা হলে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। কী নির্মম হত্যা! সীমান্তে মানুষ হত্যা ও তিস্তার পানি সংকটের কথা ফেসবুকে লিখে তিনি কি অন্যায় করেছেন? যারা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়, তারা কারা? যারা কলম কেড়ে নিয়ে কারাগারে বন্দি করে, কারাগারেই মেরে ফেলে, তারা কি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। স্বাধীন মুক্ত চিন্তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা কোথায়Ñরাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন করতে চাই।

কালো মুখোশ পরা সাতজন মিলে একজনকে মাটিতে ফেলে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। অসহায় সেই মানুষটি বাঁচার কাতর আর্জি জানিয়ে চলেছেন। কিন্তু কালো মুখোশ পরানো সেই নরপশু মানুষদের হাত থেকে তাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসছেন না, বরং ভিড় করে দেখে চলেছেন সে ঘটনা। এই  ঘটনাটি পথনাটকের দৃশ্য। সুতরাং গল্প হলেও বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় এমনি দৃশ্য লক্ষ করা যায়। আমাদের সমাজের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর একটি ধর্মের নামে কুসংস্কার-হানাহানি। ধর্মের নামে বিভাজন, মারামারি আর লুটপাটের দরুন কোন পথে যাচ্ছে দেশ?

‘আমার ভাষা আমার অধিকার’ বলে যাব, লড়ে যাব। এমন দাবিতে সারাদেশে বিভিন্ন মহল থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলসহ সংশোধনের দাবি উঠলেও এখন পর্যন্ত সরকারের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ আইন বাতিলের দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে অনেক সংগঠন। এর পরও রাষ্ট্র নীরব কেন? আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কি খর্ব হচ্ছে না?

ভুয়া তথ্য বা গুজব প্রতিরোধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের দেশে তিন বছর হলো কার্যকর হয়েছে। এই আইন ঔপনিবেশিক কালের আইনের সমতুল্য, কারণ সেই সময়ে শাসকেরা কোনো তিক্ত সত্যকে দাবিয়ে রাখার জন্য মানুষকে শাস্তির মুখোমুখি করতেন। ফলে আমাদের দেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) নামের সেই আইন ব্যবহার করে এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার হরণ ও ভিন্নমত দমনের একটি কালো আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ফলে জনমনে আতঙ্ক ও উদ্বিগ্ন রয়েছে। সবার মধ্যে এখন ভীতি কাজ করছে। বেশি কিছু লিখতে নেই, বেশি কিছু বলতে নেই এমন কথা শুনতে হয় প্রতি মুহূর্তেই। রক্তের বদলে স্বাধীন দেশ আমাদের স্বাধীনতা কোথায়?

গত ১৭ মার্চ সকালে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হাবিবপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁওয়ে সংখ্যালঘুদের গ্রামে হামলা চালানো হয়। ওই গ্রামের ঝুমন দাস নামে একজন হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেনÑএমন অভিযোগ তুলে ওই হামলা চালানো হয়। ঝুমন দাস একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে পোস্ট দিয়েছিলেন। ঘটনার পাঁচ দিন পর পুলিশ হেফাজতে থাকা ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে জিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। এখনও কোনো তদন্ত প্রতিবেদন বা চার্জশিট দেয়া হয়নি। ঝুমন দাস জামিনও পাননি। তিনি পাঁচ মাস ধরে কারাগারে আছেন। তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে তো কিছু লেখেননি, তাহলে ধর্মের অবমাননা হয় কীভাবে? সত্যি আজব দেশকি গজব কাহানিয়া! ঝুমন দাস কী ধরনের অপরাধী, তা জাতির কাছে স্পষ্ট করতে হবে। সাতবারের চেষ্টায়ও জামিন পাননি ঝুমন। অথচ সংখ্যালঘুদের পল্লিতে হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার ৫২ জনের সবাই এখন জামিনে মুক্ত। তাহলে আইনের ন্যায় প্রয়োগ কোথায়? ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে শাল্লার হিন্দুপাড়ায় হামলা হয়েছে; মন্দির ও ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং সম্পদ লুট করা হয়েছে। ঝুমন দাসের স্ত্রী গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার ঘরে রক্ষিত ৫০ হাজার টাকা দুর্বৃত্তরা নিয়ে গেছে। এমন চিত্র বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। চলতি জুলাই মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলায় অন্ততপক্ষে ৪৩৩ জন কারাবন্দি আছেন। তাদের বেশিরভাগকেই অনলাইনে ভুল ও আক্রমণাত্মক তথ্য প্রকাশের অভিযোগে আটক করা হয়েছে। অ্যামনেস্টির অভিযোগ, যাদেরকে আইনটির লক্ষ্য বানানো হয়েছে, তাদের মধ্যে সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, গায়ক, অ্যাক্টিভিস্ট, উদ্যোক্তা, শিক্ষার্থী, এমনকি লেখাপড়া না জানা এক কৃষকও রয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় লেখক মুশতাক আহমেদ বিচারবিহীনভাবে ১০ মাস ধরে কারাগারে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেছেন। ঝুমন দাসের মা, বাবা, স্ত্রী ও ১১ মাস বয়সের একটি কন্যাশিশু রয়েছে। অসচ্ছল, গরিব ও অসহায় পরিবার। ঝুমন দাস কারাগারে থাকায় তাদের খাবার দেবে কে? তার সন্তানের ভবিষ্যৎ কী? রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী? রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বত্র মৌলবাদী মননজগৎ তৈরি হয়েছে? সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে ব্যাপক মাত্রায়। ফলে এটি যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে রাষ্ট্রকে চরম মূল্য দিতে হবে। নিরপরাধ ঝুমন দাসের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। তার সম্পদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর ওই গল্পের পথনাটকের মতো দর্শকের ভূমিকা করলে চলবে না। তাই মৌলবাদী মননভূমির বিরুদ্ধেই জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। গণতন্ত্র মানেই ভিন্নমতে বিশ্বাস এ কথা রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে। ফলে দেশপ্রেমহীন মানুষ নয়, মানবিক রাষ্ট্র গড়তে দেশপ্রেমিক মানুষ চাই।

শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ

জয়পুরহাট সরকারি কলেজ