মো. জিল্লুর রহমান: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার ও বিকাশ চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি, যার মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি। এর মাধ্যমে সরকারি যেকোনো বিশেষ ঘোষণা মোবাইল ফোনের খুদে বার্তার মাধ্যমে সরাসরি ওইসব ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়া যাচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে দেশের নাগরিকরা অনলাইনে আবেদন করে দেশের ৬৪টি জেলায় স্থাপিত ই-সেবা কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন ধরনের সেবা গ্রহণ করতে পারছে। অন্যদিকে সরকারি ওয়েবসাইট বা ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও দিকনির্দেশনা সরাসরি জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া যাচ্ছে। সরকারি এসব তথ্য ও সেবা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দেশে তৈরি করা হয়েছে বেশ কটি সরকারি মোবাইল হেল্পডেস্ক। এই মোবাইল হেল্পডেস্কগুলোর নির্দিষ্ট নম্বরে কল করার মাধ্যমে মানুষ সহজেই সরকারি তথ্য ও সেবা পাচ্ছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশের কারণে পোস্টাল ক্যাশ কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার সিস্টেম প্রভৃতির মাধ্যমে বর্তমানে একস্থান থেকে অন্যস্থানে অর্থ পাঠানো তুলনামূলকভাবে সহজ ও দ্রুততর হয়েছে। ইন্টারনেট ও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও টাকা দ্রুত ও কম খরচে যেকোনো সময় স্থানান্তরিত করা যায়। তাছাড়া গ্রাহকরা ঘরে বসেই বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস বিল, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন, পরীক্ষার নিবন্ধন, চাকরির আবেদন, জš§নিবন্ধন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন এবং ট্রেন, বাস ও উড়োজাহাজের টিকিট ঘরে বসে অনলাইনে বা মোবাইলের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারে।
তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, উন্নত প্রযুক্তি, সহজ অ্যাকসেস ও দিনকে দিন নতুন প্ল্যাটফর্ম আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে সাইবার অপরাধ এবং এর ঝুঁকি। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে অপরাধেরও নতুন ধরন পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে চারটি ভিন্ন আইনের অধীনে প্রতি মাসে গড়ে ১৬৯টি সাইবার মামলা করা হয়েছে। ২০২১ সালে এই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৪টি। আসলে সাইবার অপরাধের ধরন দিনকে দিন বদলে যাচ্ছে, সেইসঙ্গে বাড়ছে অপরাধের সংখ্যাও। সহজেই ইন্টারনেটের অ্যাক্সেস ও নজরদারির অভাবের কারণেই এমনটা হচ্ছে। এসব অপরাধের বেশিরভাগই মানুষের সরলতাকে পুঁজি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এমনকি এ ধরনের কার্যক্রমে বিদেশি নাগরিকদেরও সংশ্লিষ্টতাও দেখা গেছে। যেমন গত ২১ এপ্রিল পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ১১ নাইজেরীয় নাগরিককে জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। বাংলাদেশি সহযোগীদের পাশাপাশি বিদেশি এই নাগরিকরাও ফেসবুকে বিভিন্ন ব্যক্তিদের টার্গেট করতেন এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার পরে উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেন।
মূলত সাইবার নিরাপত্তা হচ্ছে এমন কিছু উপায়, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য, কম্পিউটার এবং আমাদের বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল ডিভাইসকে হ্যাকিং ও বিভিন্ন ধরনের আক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখতে পারি। আমরা এখন পুরোপুরি নেটওয়ার্কবেষ্টিত একটি পরিবেশে থাকি। ইন্টারনেট অ্যাক্সেস এখন সবকিছুতেই। এমনকি আমাদের স্মার্ট ডিভাইসটিও থাকে ইন্টারনেট জগতের সঙ্গে সংযুক্ত। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইনে যে অপরাধগুলো করা হয় তাকে বলা হয় সাইবার ক্রাইম বা অপরাধ। সাইবার অপরাধের একটি বড় অংশ হচ্ছে প্রতারণা। ভুল পরিচয় ও ভুল তথ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে নানাভাবে যোগাযোগ করা হয় এবং তাদের নানাভাবে প্রতারিত করার চেষ্টা করা হয়। যেমন প্রতারণার মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং থেকে প্রায়ই অর্থ হাতিয়ে নেয়ার খবর শোনা যায়।
বেশ কয়েক বছর আগে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আট কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা সুইফট পেমেন্ট পদ্ধতিতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। এই অর্থ ফিলিপাইনের মাকাতি শহরে রিজাল ব্যাংকের শাখায় চারটি অ্যাকাউন্টে যায় এবং সেখান থেকে দ্রুত টাকা উত্তোলন করা হয়। পরে বিভিন্ন সময় এক কোটি ৫০ লাখ ডলার ফেরত আসে। এখনও ছয় কোটি ৬০ লাখ ডলার উদ্ধার হয়নি। এই ডলারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট বা ভল্ট থেকে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশের রিজার্ভ ডলার থেকেই হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে জালিয়াতি করে নেয়া হয়েছিল। এর আগে বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ ও এর নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহ বা ধারণা ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর থেকেই সরকার, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ব্যাংকিং সেক্টরসহ অনেকেই নড়েচড়ে বসে এবং সাইবার অপরাধ ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) এর সাম্প্রতিক এক তথ্যমতে, মাত্র কয়েক বছর আগেও তারা প্রতি মাসে গড়ে প্রায় দেড় হাজার সাইবার অপরাধের অভিযোগ পেতেন। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে আড়াই হাজার। ২০২১ সালের মে থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টিকটক ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রায় ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এসব অপরাধের ধরনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ‘টিকটকে তারকা’ হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মূলত তরুণীদের প্রলুব্ধ করা হয়। ভুক্তভোগীরা একবার সেই ফাঁদে পা দেয়ার পর থেকেই শুরু হয় ভয়ংকর নির্যাতন ও পরিশেষে মানসিক ট্রমা। এই ধরনের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও বিদেশে পাচার করার মতো ঘটনা ঘটে বলে জানা যাচ্ছে।
যেকোনো ধরনের সাইবার আক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে সচেতনতা এবং জানা কীভাবে আক্রমণগুলো হয়, কীভাবে তা যেকোনো সিস্টেমকে ক্ষতি করে এবং কীভাবে তা প্রতিহত করা যায়। জেনে রাখা ভালো, একধরনের সাইবার আক্রমণ হচ্ছে ফিশিং। এক্ষেত্রে অপরাধী বলবে, তার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি গেছে, তারা বিষয়টি তদন্ত করছে; তারা আপনাকে ইউজার নাম ও গোপন পাসওয়ার্ডটি দেয়ার জন্য অনুরোধ করবে। এখন আপনি যদি ইমেইলের উত্তর দেন, তাহলে তাদের কাছে আপনার ইউজার নাম ও গোপন পাসওয়ার্ড চলে গেল এবং তারা তা ব্যবহার করে আপনার ক্ষতি করতে শুরু করল। এরকম আরও আছে, যেমন ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’। নানাভাবে ফোনে প্রতারণা করে আপনার তথ্য তারা আপনার কাছ থেকে নিয়ে নেয়। এখন যদি আপনি আপনার পাসওয়ার্ড বা এরকম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলে দেন, তাহলে আপনার আর্থিক ক্ষতি করতে পারে।
এছাড়া আছে ভাইরাস অ্যাটাক, যা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। ভাইরাস সাধারণত অজানা ইমেইল বা ফাইলের মধ্যে গিয়ে আক্রমণ করে, আপনি কোনো ভুয়া ইমেইল খুলে অ্যাটাচমেন্ট পেলেন, এখন সেটা যদি খোলেন, তাহলে ভাইরাস আপনার কম্পিউটারকে আক্রমণ করবে। কম্পিউটার ছাড়াও মোবাইল ফোন, আইওটি ডিভাইস, যা ইন্টারনেট দিয়ে চলে সবকিছুই হুমকির মুখে আছে। সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে রেনসম ওয়ের। এর মাধ্যমে একটা ভাইরাস আপনার কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দিয়ে বলবে, ‘আমাদের টাকা দাও, তা না হলে তোমার কম্পিউটার ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে।’ এই অবস্থা থেকে বাঁচতে সবচেয়ে সহজ রাস্তা হচ্ছে, আসলে আক্রমণটা কোথা থেকে এসেছে, তা নির্ণয় করা। তাই ইন্টারনেট ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
আপনি আপনার ওয়েবসাইটগুলোর জন্য বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে জটিল পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে পারেন, অন্তত ১০ থেকে ২০ ক্যারেক্টার লম্বা; এক্ষেত্রে জš§দিন বা নাম ব্যবহার করা না করাই উত্তম। আপনার যদি একাধিক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হয়, যেমন ব্যাংক, অফিস পিসি বা ইউনিভার্সিটি আইডি প্রভৃতি, সেক্ষেত্রে আপনি পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করতে পারেন, এতে আপনি সব পাসওয়ার্ড এক জায়গায় রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে জটিল পাসওয়ার্ডগুলো মাঝে মাঝে বদলে নিতে পারেন। এছাড়া এখন প্রযুক্তির যুগ, তাই টু ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন ব্যবহার করতে পারেন, এটা আপনার পাসওয়ার্ডের ওপর পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা হয় এবং এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত। ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখলে দেখতে পাওয়া যায়, মাইক্রোসফট, গুগলসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এই সার্ভিসগুলো বিনা পয়সায় দিচ্ছে।
সরকার সাইবার নিরাপত্তা এবং অপরাধ প্রতিরোধ, তদন্ত ও বিচারের উদ্দেশ্যে ২০০৬ সালে প্রণয়ন করে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন’। অন্যদিকে একই উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণীত হয়েছে। এসব আইনে অর্থদণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তায় সচেতনতার পাশাপাশি কিছু অতি প্রয়োজনীয় বিষয় জানা খুবই জরুরি। পাসওয়ার্ড, পিন, ওটিপি প্রভৃতি মনের ভুলেও কাউকে বলা বা শেয়ার করা উচিত নয়। শুধু ইউজারনেম এবং পাসওয়ার্ডই সাইবার জগতে নিরাপদ রাখতে যথেষ্ট নয়। সাইবার অপরাধ থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রথমত যারা অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে, তাদের সরকারের সাইবার ক্রাইম বিভাগের পেজে গিয়ে আইনগুলো ভালো করে পড়তে ও জানতে হবে। দ্বিতীয়ত, অনলাইনে যদি কেউ ভালোবাসা বা ব্যবসার প্রস্তাব দেয়, তাহলে তা ভালো করে যাচাই-বাছাই করতে হবে। আর তৃতীয়ত, যদি কেউ সাইবার অপরাধের শিকার হয়েই যায়, তাহলে দ্বিধাদ্বন্দ্ব না করে তথ্য দিয়ে পুরোটা বিষয়টা যথাসম্ভব খুলে বলতে হবে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য নিকটজন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা নিতে হবে।
ব্যাংকার ও মুক্ত লেখক
zrbbbp@gmail.com