নিজস্ব প্রতিবেদক: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা (সিবিডিসি) চালু হলে অবৈধ লেনদেন অনেকাংশে কমে আসবে। ফলে প্রতি বছর দেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, তাও অনেকাংশে প্রতিরোধ করা যাবে। বিশ্বের অনেক দেশে সিবিডিসি চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশেও এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এটি চালু করতে হলে অবশ্যই সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বলয় নিশ্চিত করতে হবে।
গতকাল সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘ডিজিটাল মুদ্রার অর্থনীতি: কাগুজে টাকা থেকে ডিজিটালে রূপান্তর’ শীর্ষক এক সেমিনারে তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বুয়েটের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার, বিশেষ অতিথি ছিলেন বুয়েটের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খান, সিএজি মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইমাজিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. জামাল উদ্দীন আহমেদ। এ সময় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, দেশে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে গেল ছয় বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপির ৩২ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে হওয়ায় এসব অর্থ উদ্ধার সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত ১২২টি দেশে সিডিবিসি চালু রয়েছে। বাংলাদেশে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে টেকনোলজিস্টদের এবং লিগ্যালদের বড় ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশ করতে হলে দেশ থেকে যে টাকা পাচারসহ অন্য যেসব কার্যক্রম চলছে তা বন্ধ করতে হবে। আমাদের দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার জিডিপির ৩২ শতাংশ। যেসব উন্নত দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার জিডিপির তুলনায় আরও অনেক কম তারাও সিবিডিসিকে গ্রহণ করে নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ৩০০ মিলিয়ন ডলার বাইরে আটকে থাকার যে খবর প্রকাশ করা হয়েছে, ডিজিটাল মুদ্রা চালু হলে এ সংকট তৈরি হতো না। ডিজিটাল কারেন্সি চালু হলে দেশের জিডিপিতে যে ৩২ শতাংশ বর্তমানে ছায়া লেনদেন রয়েছে তা বন্ধ হবে।
অনুষ্ঠানে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা চালু করেছে। আবার অনেক দেশ শুরু করেছে। আমাদেরও এটা নিয়ে ভাবার সময় হয়েছে। ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ডিজিটাল মুদ্রা চালু হলে কার পকেটে কী আছে সেটা রাষ্ট্র জানবে। ফলে সরকার চাইলে দুর্নীতি কমানো যাবে। এজন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। এমন প্রযুক্তিনির্ভর
অর্থ ব্যবস্থার বলয় গড়ে তুলতে সরকারের কতটা রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে, সেটিও ভেবে দেখতে হবে।
বুয়েটের প্রো-ভিসি অধ্যাপক আব্দুল জব্বার খান বলেন, ডিজিটাল মুদ্রায় যেতে হলে ইনফরমাল ইকোনমি সাইজ কমাতে হবে। একমাত্র ক্যাশলেসের মাধ্যমে তা কমানো সম্ভব। এটি অর্জন করতে পারলে ডিজিটাল মুদ্রায় যাওয়া সহজ হবে।
বুয়েটের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, বিশ্বের অনেক দেশ ডিজিটাল মুদ্রা চালু করেছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শুরু করতে হবে। যত দেরিতে শুরু হবে ততই পিছিয়ে যাব। তাই এখনই ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে চিন্তা করতে হবে।
মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার আগে ক্যাশলেস সোসাইটি নিশ্চিত করতে হবে। এর মাধ্যমেই ডিজিটাল মুদ্রা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। বলা হয়, আমাদের দেশে অর্থনীতিতে প্রকৃত কাগুজে মুদ্রা রয়েছে প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন বা ৩ লাখ কোটি টাকা; যা এরই মধ্যে ১৫ লাখ কোটি টাকার বাজার তৈরি করেছে। দেশে লেনদেন ব্যবস্থা পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর না হওয়ায় বিপুল পরিমাণে অর্থ হারাচ্ছে সরকার।
এ সময় অন্যান্য বক্তারা বলেন, ডিজিটাল মুদ্রার জন্য ইকোসিস্টেম প্রয়োজন। অর্থাৎ কাগুজে মুদ্রার মতোই এ মুদ্রা দিয়ে পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ দিতে হবে। এ মুদ্রা ব্যবস্থায় যোগ দিতে গ্রাহকদের যুক্ত হতে হবে ইন্টারনেট ব্যবস্থায়। নিতে হবে সাইবার নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জও। বিশ্বের ৪১ শতাংশ দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি চালুর বিষয়ে গবেষণা করছে। এরই মধ্যে চালু করেছে ৯ শতাংশ।
সেমিনারে বক্তারা বলছেন, এ মুদ্রা ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে বুয়েটের অধীনে একটি গবেষণা কেন্দ্র তৈরির পাশাপাশি নীতি কাঠামো নিয়ে কাজ করার সময় এসেছে।
জানা গেছে, প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্বব্যাপী আর্থিক লেনদেনেও পরিবর্তন আসছে। চালু হচ্ছে ভার্চুয়াল মুদ্রা। একে বিশ্বের অনেক দেশ স্বীকৃতি না দিলেও ডিজিটাল মুদ্রা চালুর পথে হাঁটছে উন্নত বিশ্ব, যা সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি নামে পরিচিত। বাংলাদেশও এখন সম্পৃক্ত হতে চায় এ নতুন মুদ্রা ব্যবস্থায়। সে জন্য গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটেও ডিজিটাল মুদ্রা চালুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছিল সরকার।