২০২১-২২ অর্থবছর

ডিজেলচালিত ৬ বিদ্যুৎকেন্দ্রে লোকসান ৩,১২৫ কোটি টাকা

ইসমাইল আলী: চার বছর আগে ছয়টি ডিজেলচালিত বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয় সরকার। কুইক আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) নামক এ ছয় কেন্দ্রের মোট উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু নির্মাণের পর থেকে কখনোই এগুলোর সক্ষমতার ১০ শতাংশও ব্যবহার হয়নি। এতে কেন্দ্রগুলোয় গড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ত ১০০ টাকার বেশি। ফলে কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) লোকসান গুনতে হয় অনেক বেশি।

যদিও গত অর্থবছর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার (গড়ে ১০%) হয়। এরপরও মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হয়েছে কেন্দ্রগুলোর জন্য। কারণ ২০২১-২২ অর্থবছর এসব কেন্দ্রে গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ৪০ টাকা ১০ পয়সা। আর বিদ্যুতের গড় বিক্রিমূল্য পাঁচ টাকা তিন পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে পিডিবির লোকসান হয়েছে ৩৫ টাকার বেশি।

পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছর ডিজেলচালিত ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পিডিবি মোট বিদ্যুৎ কিনেছে ৮৭ কোটি ৭৬ লাখ ইউনিট। এতে মোট ব্যয় হয় তিন হাজার ৫১৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর ওই বিদ্যুতের বিক্রিমূল্য ৩৯৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা। অর্থাৎ ডিজেলচালিত ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্রে পিডিবিকে লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় তিন হাজার ১২৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এতে ভর্তুকির বোঝা বেড়েছে সরকারের। তাই ভর্তুকি কমাতে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে কেন্দ্রগুলো।

যদিও বসিয়ে রেখে এসব কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে পিডিবিকে। গত অর্থবছর কেন্দ্রগুলোর জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে এক হাজার ৮৭৩ কোটি চার লাখ টাকা। চলতি অর্থবছর কেন্দ্রগুলোয় কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও একই পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে।

তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর ডিজেলচালিত ছয় কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকসান ছিল ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে নির্মিত এপিআর এনার্জি কেন্দ্রটির। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ কেন্দ্রটিতে বছরে কমপক্ষে ২১৬ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। অথচ গত অর্থবছর কেন্দ্রটিতে মাত্র ২৫ কোটি ৯৫ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যা সক্ষমতার ১০ শতাংশ। যদিও কেন্দ্রটির জন্য ৫৬১ কোটি দুই লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় পিডিবিকে। আর কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৬৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ৪০ টাকা ৯৯ পয়সা। আর মোট লোকসান গুনতে হয়েছে ৯৪৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

গত অর্থবছর ডিজেলচালিত ছয় কেন্দ্রের মধ্যে লোকসানের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল কুমিল্লার দাউদকান্দিতে স্থাপিত বাংলা ট্র্যাকের (ইউনিট-১) ২০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি। এ কেন্দ্রে বছরে কমপক্ষে ১৪৪ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছর এ কেন্দ্রটিতে মাত্র ১৫ কোটি ৯২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যা সক্ষমতার ৯ শতাংশ।

গত অর্থবছর কেন্দ্রটির জন্য ৩৬৭ কোটি দুই লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় পিডিবিকে। আর বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয় হয়েছে ৬৬৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি গড়ে ৪২ টাকা দুই পয়সা। ফলে লোকসান গুনতে হয়েছে ৫৯৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

লোকসানের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে ছিল সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়িতে স্থাপিত প্যারামাউন্ট বি. ট্রাক এনার্জি কেন্দ্রটি। এর উৎপাদন ক্ষমতা ২০০ মেগাওয়াট। ডিজেলচালিত এ কেন্দ্রটি থেকে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ কেনা হয় মাত্র ১০ কোটি ৪৮ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যা সক্ষমতার মাত্র ছয় শতাংশ। গত অর্থবছর কেন্দ্রটির জন্য ৩৭৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে পিডিবিকে। আর কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয় হয়েছে ৫৫৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি গড়ে ৫৩ টাকা ২২ পয়সা। ফলে লোকসান গুনতে হয়েছে ৫১০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে কেরানীগঞ্জের ওরাহাটিতে নির্মিত এগ্রিকো এনার্জি সল্যুশন লিমিটেড কেন্দ্রটি। ১০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি থেকে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ কেনা হয় ১৩ কোটি ১৫ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যা সক্ষমতার ১৫ শতাংশ। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ৪৩৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৯১ কোটি ২২ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ। কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ৩৩ টাকা ৪০ পয়সা। আর মোট লোকসান হয় ৩৮০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

এদিকে লোকসানের দিক থেকে গত বছর পাঁচে থাকা কেরানীগঞ্জের ব্রাহ্মণগাঁওয়ে অবস্থিত এগ্রিকো পাওয়ার সল্যুশন কেন্দ্রটি গত অর্থবছর চলেছে মাত্র ১৪ শতাংশ সময়। ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে এ সময় ১২ কোটি পাঁচ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। তবে কেন্দ্রটির সক্ষমতা ৭২ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা।

গত অর্থবছর এ কেন্দ্রের জন্য ১৮৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়। ২০২১-২২ অর্থবছর কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয় হয় ৪১৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর গড়ে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়ে ৩৪ টাকা ৮২ পয়সা। ওই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে পিডিবির লোকসান হয়েছে ৩৬৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা।

ডিজেলচালিত অপর কেন্দ্রটি যশোরের নওয়াপাড়ায় অবস্থিত বাংলা ট্র্যাক (ইউনিট-২)। ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ১০ কোটি ২১ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যা সক্ষমতার প্রায় ১২ শতাংশ। গত অর্থবছর এ কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়েছে ৩৬ টাকা ২০ পয়সা। এ কেন্দ্রটির ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১৮৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। আর কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয় হয়েছে ৩৬৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এতে কেন্দ্রটিতে মোট লোকসান গুনতে হয়েছে ৩২৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

সবমিলিয়ে ছয় কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ব্যয়ের ৮৮ দশমিক ৮১ শতাংশই লোকসান ছিল পিডিবির। জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ঘাটতি মেটাতে চার বছর আগে ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। দ্রুত উৎপাদন শুরুর জন্য এসব কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়। তবে পরবর্তীতে চাহিদা কম থাকায় এগুলোয় উৎপাদন করা হতো কম। যদিও গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় গত অর্থবছর এগুলোয় উৎপাদন কিছুটা বাড়ানো হয়। তবে ভর্তুকি কমাতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এগুলো বর্তমানে বন্ধ রাখা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ডিজেলচালিত কুইক আইপিপি কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ আর এক বছর আছে। এছাড়া ডিজেলচালিত কেন্দ্র আর না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে আগামী অর্থবছর কেন্দ্রগুলোর চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এতে পিডিবির ব্যয় অনেকটাই সাশ্রয় হবে।