ডেঙ্গুজ্বরে আতঙ্ক নয় সচেতনতাই কাম্য

রামিছা বিলকিছ জেরিন: যান্ত্রিক সভ্যতা বিশ্বমানবকে বেশ এগিয়ে দিয়েছে। এই সভ্যতা মানুষকে দিয়েছে ভোগবিলাসের সুযোগ, অবিমিশ্র সুখস্বাচ্ছন্দ্য, শান্তি ও সুস্থির পরিবেশ। তবে এই শতাব্দীতে জীবন যেমন প্রসারিত হয়েছে, ঠিক ততটাই সংকুচিতও হয়েছে; সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে সব ব্যবস্থাকে। পরিবেশদূষণ এর মধ্যে অন্যতম। এই দূষণের ফলে জš§ নিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণু। বিশেষ করে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। সারাবছরই ডেঙ্গুজ্বর হতে দেখা যায়। বিশেষ করে ঢাকায় এর সংক্রমণ বেশি।

কভিডের কশাঘাতের পর দেশে চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। এডিস মশাবাহিত রোগ এই ডেঙ্গু। হঠাৎ ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে গেছে। ফলে দিন দিন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি মৃত্যুর মিছিলও দীর্ঘ হচ্ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন নতুন নতুন রোগী। অনেকেই বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সম্প্রতি ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কিত নগরবাসী। দিন যতই যাচ্ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ ততই বাড়ছে। সরকারি হিসাবে চলতি বছরে ১ জানুয়ারি থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আট হাজার ৩৯০ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন সাত হাজার ৩৩৫ জন। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ রোগী ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা। ১০ সেপ্টেম্বর ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এ নিয়ে জানুয়ারির ১ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু হয়েছে ৩২ জনের। এ বছর ২১ জুন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এদিকে গত আগস্ট মাসে তিন হাজার ৫২১ ডেঙ্গু রোগী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও চলতি মাসের প্রথম আট দিনে বিভিন্ন হাসপাতালে এক হাজার ৭৭০ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ সময়ে মারা গেছেন ১০ জন। এ ছাড়া আগস্টে মারা গেছেন ১১ জন, জুলাইয়ে ৯ জন ও জুনে একজন। ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়ে এলেও বিভিন্ন ক্লিনিক ও বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নেয়া রোগীর সংখ্যা অজানাই থেকে যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হিসাবের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

গত কয়েক মাসে ধারাবাহিকভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে। এই সময়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতন থাকতে হবে। এডিস মশার বংশবিস্তারের স্থান নিয়ন্ত্রণ করা না হলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বড় আকারে দেখা দিতে পারে। এ বছর তুলনামূলকভাবে কম পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে। সে হিসেবে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাওয়ার কথা। তবে বাস্তবে ঘটছে সম্পূর্ণ উল্টোটা। নগরজুড়ে বেড়েছে এডিস মশার বিস্তার। সিটি করপোরেশন এডিসের লার্ভা ধ্বংস করতে ব্যর্থ হওয়ায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। ডেঙ্গুর মৌসুমে সিটি করপোরেশন মশা নিধনে আন্তরিক না হওয়ায় এই সময়ে চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। এখনই সিটি করপোরেশন কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ২০১৯ সালের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। অন্যথায় সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে রোগী সামাল দেয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য বাসাবাড়ির আনাচে-কানাচে, নির্মাণাধীন ভবনে ও ফুলের টবে জমা পানি তিন দিন পরপর ফেলে দিতে হবে। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশন বলছে, এখনও নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে ডেঙ্গু।

এদিকে ঢাকা সিটির দুই মেয়র বলে আসছেন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতির কথা। বিভিন্ন স্থানে অভিযানও চালিয়েছেন তারা। আর ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৯ সালে দেশে স্মরণকালের ভয়াবহ ডেঙ্গুরোগ ছড়িয়েছিল। সবচেয়ে বড় ধাক্কা সামলেছে তখন বাংলাদেশ।

এর আগে এত বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হতে আসেনি। এমনকি রোগীর সংখ্যা গত ১৯ বছরে দেশে মোট আক্রান্ত সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে দেশে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত ১৯ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগী ৫০ হাজার ১৭৬ জন।

ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য ডিএনসিসির মেয়র বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ডিএনসিসির ১০টি অঞ্চলে ১০টি টিম অভিযান পরিচালনা করবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হবে। বাসাবাড়ি ও অফিসে জমে থাকা পানিতে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মেয়র আরও বলেন, এডিসের লার্ভা পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী নিয়মিত মামলা হবে। কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আপনার বাড়ি বা স্থাপনার ভেতরে, বাইরে ও আশপাশে কোথাও পানি জমে থাকলে এখনই ফেলে দিন। ডেঙ্গু থেকে আপনি সুরক্ষিত থাকুন, আপনার পরিবার ও প্রতিবেশীকেও সুরক্ষিত রাখুন। বাড়িতে লার্ভার চাষ করে শাস্তি না পেয়ে বরং লার্ভার উৎস ধ্বংস করে পুরস্কৃত হোন। ডিএনসিসি মেয়র আরও বলেন, ধারণা করা হয়েছিল অন্যান্য সময়ের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তাই বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই আমরা বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সচেতন করাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে আসছি। তবে আগের সঙ্গে পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেকটা কম। আমাদের কার্যকর পদক্ষেপের কারণে এখন পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি। পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের তুলনায়ও আমাদের দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেক কম। ডেঙ্গু পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করাই আমাদের লক্ষ্য।”

স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণখানের মধ্য আজমপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি বাড়িতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী রয়েছে। ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম সরেজমিনে এলাকাটি পরিদর্শন করেন। দেখা গেছে, এই এলাকায় অনেকগুলো ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। বেশ কয়েকটি নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমে আছে। একটিতে এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। এ সময় নির্মাণাধীন ভবনটিতে এডিসের লার্ভা পাওয়ায় ডিএনসিসির আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. জুলকার নায়ন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এক লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেন।

পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দূষিত শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম। রাস্তাঘাট, অলিগলি ও নালা-নর্দমা বেশ নোংরা হয়ে থাকে। ময়লা পানি জমে থাকে। সব ধরনের বর্জ্য নালা-নর্দমায় আটকে ঢাকার বাতাসকে বিষাক্ত করে তুলেছে।

নোংরা জায়গায় ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী ক্ষুদ্র পতঙ্গ এডিস মশার জš§ হয়। এর দংশনে হাজারো মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে।

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগ। সাধারণত মানুষের আবাসস্থলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দিনের বেলার দংশনকারী অবফবং ধবমুঢ়ঃর মশা এসব ভাইরাসের বাহক। কোনো কোনো অঞ্চলে অন্যান্য প্রজাতি অবফবং ধষনড়ঢ়রপঃঁং ও অবফবং ঢ়ড়ষুহবংরবহংরং মশাও সংক্রমণ ঘটায়। রোগীকে দংশনের দুই সপ্তাহ পর মশা সংক্রমণক্ষম হয়ে ওঠে এবং গোটা জীবনই সংক্রমণশীল থাকে?

ডেঙ্গুজ্বরের বিভিন্ন লক্ষণ ও প্রকার রয়েছে। রক্তজ্বরা ডেঙ্গু ও ডেঙ্গু শক সিনড্রম দেখা যায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়। রক্তজরা ডেঙ্গু মূলত শিশুদের রোগ। ডেঙ্গু হলে প্রচণ্ড জ্বর হয়, একইসঙ্গে মাথার সামনে ব্যথা, চক্ষুগোলকে ব্যথা, বমি ভাব প্রভৃতি দেখা দেয়। এই ডেঙ্গুজ্বর হওয়ার কারণ মূলত আমরা নিজেরাই। এর সংক্রমণ ঘটে আমাদেরই কাজে অবহেলার কারণে। আমাদের জনবসতি ও বাসাবাড়ি পরিষ্কার থাকলে কখনোই ডেঙ্গুর সংক্রমণ হবে না। ডেঙ্গুর লার্ভা বেশিরভাগ সময় পরিত্যক্ত টায়ার, বালতি, ফেলে দেয়া নারিকেলের খোল, ফুলদানি, ফুলের টব ইত্যাদি স্থানে জমে থাকা পানি, এমনকি জমে থাকা গাছের গর্ত এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক স্থানে বড় হয়।

ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক নেই। দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাই কেবল রোগের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। সাধারণত ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর বিরুদ্ধেই দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে, কিন্তু রক্তক্ষরা ডেঙ্গুতে বেশিরভাগই মারা যায়। তাই মশার বিরুদ্ধেই নিয়ন্ত্রণ পরিচালিত হওয়া উচিত। শুধু প্রশাসনকেই সচেতন বা নিয়ন্ত্রণের অভিযান পরিচালনা করলে হবে না, সাধারণ জনগণকেও নীতিমালা মানতে হবে এবং প্রশাসনকে সহায়তা করতে হবে। জনগণের সচেতনতাই পারবে ডেঙ্গু থেকে মুক্তি দিতে।

শিক্ষার্থী

ইসলামী শিক্ষা বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়