ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

মশিউর রহমান: বাংলাদেশ ২০০৭ সাল থেকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা ভোগ করে আসছে। ইউএনএফপিএ’র মতে একটা দেশের মোট জনসংখ্যার কর্মক্ষমহীন জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যার আধিক্যকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলে চিহ্নিত করা হয়, যেখানে দেশের যুব জনসংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা সাধারণত ২০-৩০ বছরের বেশি ভোগ করা যায় না। ২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর সমন্বয়কৃত জনসংখ্যার চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০২২ সালের জুনে প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৫১ লাখ, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে যেখানে দেখা যায় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন।

এ দুটি প্রতিবেদনেই একটি অভিন্ন তথ্য হচ্ছে বাংলাদেশে রয়েছে তরুণ এবং কর্মক্ষম জনসংখ্যার আধিক্য। বাংলাদেশ সরকারের অভীষ্ট লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি বাস্তবায়নেও বাংলাদেশ সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এ দুই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। সুষ্ঠু পরিকল্পনা, বিনিয়োগ, দক্ষকর্মী অর্থাৎ মানবসম্পদ তৈরি করার মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার এই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। কভিডকালে খানিকটা ধীরগতিতে চলা বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ কর্মক্ষম জনসংখ্যার আধিক্যকে কাজে লাগানো যায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে ইউএনএফপিএ সংজ্ঞানুযায়ী মোট কর্মক্ষম অর্থাৎ ১৫-৬৪ বছর বয়সী জনসংখ্যা ১১ কোটি ৭ লাখ। এ জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫.৩ শতাংশ। ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটি ৫০ লাখ, যা কিনা দেশের মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশ। দেশের মোট তরুণ অর্থাৎ ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৭৪ লাখ, যা কিনা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭.৯৬ শতাংশ। কর্মক্ষমহীন জনসংখ্যা বলতে ১৪ বছরের নিচে এবং ৬৫-এর বেশি বয়সী মানুষকে বোঝায়, যাদের আমরা নির্ভরশীল জনসংখ্যা বলে চিহ্নিত করতে পারি। টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বছর অর্থাৎ ২০৩০ সালে বাংলাদেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা হবে ১২ কোটি ৯৮ লাখ এবং ২০৪১ সালে যা আরও বৃদ্ধি পাবে।

২০১১ এবং ২০২২ সালের প্রায় এক দশকের বেশি সময়ের দুই জনশুমারির মধ্যে তুলনা করলে আমরা দেখতে পাই ২০১১ সালে বাংলাদেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী জনসংখ্যা ছিল ১৮.১৬ শতাংশ। যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৯.১১ শতাংশে, যেখানে দেশের তরুণ (১৫-২৪) জনসংখ্যার পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি ১৫ লাখ ৬০ হাজার। ২০১১ সালে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনসংখ্যা ছিল ৫৮ শতাংশ, যা কিনা ২০২২ সালে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

জনসংখ্যার এ ইতিবাচক বৃদ্ধিকে বিশেষজ্ঞরা দেখছেন এক বিরাট সম্ভাবনা হিসেবে। বাংলাদেশ ২০৩৮ সাল পর্যন্ত ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা ভোগ করবে। কারণ কর্মক্ষম জনসংখ্যার পাশাপাশি বাংলাদেশে বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও। কোনো দেশে যদি জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হয় তবে তাকে বলা হয় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের বোনাসকাল। জনসংখ্যার এ স্বর্ণযুগকে বাংলাদেশ কীভাবে ব্যবহার করবে তার ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।

দক্ষ মানবসম্পদের পুরো ফায়দা উঠাতে দক্ষ কর্মী রপ্তানি হতে পারে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটা নির্ভর করে দেশের প্রবাসী আয়ের ওপর। সরকারি খরচে এবং ব্যবস্থাপনায় ভবিষ্যতে বিদেশগামী কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে প্রবাসী আয়ে দেশের অর্থনীতি অনেকটা এগিয়ে নেয়া সম্ভব। সম্প্রতি নি¤œমুখী প্রবাসী আয়কে ঊর্ধ্বমূখী করতে চাইলে দক্ষ মানবসম্পদ রপ্তানির বিকল্প নেই।

বিবিএস মতে বাংলাদেশে কর্মহীন জনগোষ্ঠী প্রায় ৩.৫ শতাংশ যদিও কর্মহীন বা বেকার জনসংখ্যার ব্যাপারে বিবিএসের সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। বিবিএস এবং ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) তথ্যমতে কোনো ব্যক্তি যদি সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করেন তবে তিনি বেকার নন বরং কর্মজীবী। অথচ সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে যে অর্থ উপার্জন করা যায় তা খুব বেশি নয়। ২০২২ সালের আগস্টে ট্রান্সপারেসি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের মতে বাংলাদেশের মোট শিক্ষিত জনসংখ্যার ৪৭ শতাংশ বেকার এবং আইএলও মতে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যায় বেকারত্বের হার ১০.৫ শতাংশ। এ সুপ্ত বা ছদ্মবেকারদের উৎপাদনমুখী কর্মে নিয়োজিত করা যেতে পারে। আত্মকর্মসংস্থান হতে পারে দেশে উৎপাদনের এক বড় উপায়। কারিগরি শিক্ষার প্রসার এবং যুব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ বেকার জনগোষ্ঠীকে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলা যায়, যারা দেশের চলমান ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

একটি দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাকে ঘরে বেকার বসিয়ে রেখে দেশের অভীষ্ট উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারী শিক্ষার প্রসারে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভূমিকাকে ভবিষ্যতে আরও বেগমান রাখতে হবে। পাশাপাশি গার্মেন্ট সেক্টর যেখানে দেশের বৃহৎ সংখ্যক নারীর কর্মসংস্থান হয়, সেখানে নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক বেতন কাঠামো, মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং শ্রম আইনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। দেশের খাদ্য ঘাটতি নির্মূল করাসহ মৎস্য খাত এবং কৃষি খাতকে রপ্তানিযোগ্য করে তুলতে হবে। বেকার জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশকে এখানে কাজে লাগানো সম্ভব। পর্যটন খাতকে আরও বেগমান করতে দক্ষ কর্মী গড়ে তোলা যেতে পারে। পাশাপাশি দেশের সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যটন উপযোগী করে তুলতে হবে, যাতে বিদেশি পর্যটক বেশি আকৃষ্ট হয়।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের এ স্বর্ণযুগ হতে পারে বাংলাদেশের পরিবর্তনের এক উৎকৃষ্ট সময়। দেশের ভবিষ্যৎ এবং অর্থনীতির চাকা বেগমান করতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের ইতিবাচক ফায়দা আমাদের পুরোপুরি নিতে হবে। ভবিষ্যতের জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন দেশের প্রতিটি মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের এ সুবিধা নিয়েই বাংলাদেশ তার অভীষ্ট লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় নিজের অবস্থান গড়ে তুলতে পারে।

শিক্ষার্থী, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়