ইসমাইল আলী: ঢাকা শহরের চারপাশ দিয়ে বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণ করতে চায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। এজন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিস্তারিত নকশা প্রণয়নে কাজ চলছে। গতকাল এ-সংক্রান্ত খসড়া সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে সিউয়ান সার্ভে অ্যান্ড ডিজাইন গ্রুপ কোম্পানিটি। এতে প্রকল্পটির রুট, সম্ভাব্য ব্যয় ও ভাড়া তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বৃত্তাকার রেলপথের দৈর্ঘ্য হবে ৮০ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৭০ দশমিক ৯৯ কিলোমিটার হবে এলিভেটেড (উড়ালপথ)। বাকি ৯ দশমিক ৯ কিলোমিটার হবে আন্ডারগ্রাউন্ড তথা মাটির নিচ দিয়ে। পুরো রুটে স্টেশন থাকবে ২৪টি। এর মধ্যে ২১টি স্টেশন হবে এলিভেটেড ও তিনটি আন্ডারগ্রাউন্ড। আর এ বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৩৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৭১ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ৮৭৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
যদিও এ ব্যয় প্রস্তাবিত ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড ট্রেনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। সূত্রমতে, সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে অপর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ডিজাইন ও বাংলাদেশের মজুমদার এন্টারপ্রাইজ। ২২৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার হাইস্পিড এ রেলপথ নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৪৪০ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
প্রতিবেদন দুটি বিশ্লেষণ দেখা যায়, বৃত্তাকার রেলপথে চলাচল করবে সাধারণ মেট্রোরেল। এর গতি হবে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার। আর হাইস্পিড ট্রেনের গতি হবে ঘণ্টায় ২৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার। উভয় রেলই চলবে বিদ্যুতে। আর উভয় রেলই হবে স্ট্যান্ডার্ডগেজ। ফলে বৃত্তাকার রেলপথের ব্যয় অনেক কম হওয়ার কথা বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা। আবার বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণব্যয় বেশি হওয়ায় এ ট্রেনে যাত্রীপ্রতি ভাড়াও অনেক বেশি পড়বে।
তথ্যমতে, বৃত্তাকার রেলপথটি টঙ্গী, আব্দুল্লাহপুর, ধউর, বিরুলিয়া, গাবতলী, রায়েরবাজার, বাবুবাজার, সদরঘাট, কামরাঙ্গীরচর, পোস্তগোলা, ফতুল্লা, চাষাঢ়া, সাইনবোর্ড, শিমরাইল, পূর্বাচল সড়ক, ত্রিমুখ হয়ে টঙ্গীকে পুনরায় যুক্ত করবে। এর মধ্যে সড়ক প্রশস্ত না হওয়ায় গাবতলী, সদরঘাট হয়ে পোস্তগোলা অংশ এবং কামরাঙ্গীরচর-শ্যামপুর অংশ আন্ডারগ্রাউন্ড হবে।
বৃত্তাকার রেলপথের স্টেশনগুলো হবে টঙ্গী, ত্রিমুখ, পূর্বাচল উত্তর, পূর্বাচল, বেরাইদ, ত্রিমোহনী, ডেমরা, সিদ্ধিরগঞ্জ, আদমজী, চিত্তরঞ্জন মোড়, চাষাঢ়া, ফতুল্লা, পাগলা, পোস্তগলা, সদরঘাট, কামরাঙ্গীরচর, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, ঢাকা চিড়িয়াখানা দক্ষিণ, চিড়িয়াখানা, উত্তরা, ধউর ও বিশ্ব ইজতেমা মাঠ। এর মধ্যে সদরঘাট, কামরাঙ্গীরচর ও সিদ্ধিরগঞ্জ স্টেশন তিনটি হবে আন্ডারগ্রাউন্ড।
বৃত্তাকার রেলরুটের স্টেশনগুলোর মধ্যে ১২টি হবে ট্রান্সফার স্টেশন ও ১১টি ট্রানজিট স্টেশন। এ ট্রানজিট স্টেশনগুলো বিআরটি (বাস র্যাপিড ট্রানজিট) ও মেট্রোরেলের সঙ্গে যুক্ত করবে। আর সদরঘাটের স্টেশনটি ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়ে তথা নৌপথকে যুক্ত করবে।
বৃত্তাকার রেলপথের ডিপো হবে ডেমরায় ও স্ট্যাবলিং ইয়ার্ড হবে ত্রিমুখের কাছে। আর উত্তরা, কামরাঙ্গীরচর ও ডেমরায় হবে বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন। এছাড়া প্রতিবেদনে বৃত্তাকার রেলপথে ২০৩৫ ও ২০৫৫ সালের সম্ভাব্য দৈনিক যাত্রী প্রক্ষেপণও তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ২০৩৫ সালে এ রেলপথে দৈনিক যাত্রী হবে ১০ লাখ ৬৫ হাজার ও ২০৫৫ সালে ১৫ লাখ ৭৫ হাজার।
প্রতিবেদনে বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্য ব্যয় তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, রেলপথ নির্মাণে খরচ হবে ৪০৬ কোটি ৯২ লাখ ডলার। এর মধ্যে স্টেশন নির্মাণে ৪৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলার, রেলপথ নির্মাণে ২৪১ কোটি পাঁচ লাখ, ট্র্যাক নির্মাণে ২১ কোটি ২৯ লাখ, টেলিকমিউনিকেশনে আট কোটি ৯০ লাখ, সিগনালে ১৩ কেটি ৩২ লাখ, পাওয়ার সরবরাহে ৩৯ কোটি ৯৯ লাখ, যাত্রী ফেসিলিটি ও প্ল্যাটফর্ম নির্মাণে সাত কোটি ৭৭ লাখ, ডিপো নির্মাণে ১৯ কোটি ১২ লাখ ডলার উল্লেখযোগ্য। বাকিটা অন্যান্য নির্মাণ খাতে যাবে।
এর বাইরে জমি অধিগ্রহণ ও অন্যান্য খরচ ১২৯ কোটি ৩২ লাখ ডলার, কনটিনজেন্সি (ব্যয় ও ভৌত সমন্বয়) ১৬৪ কোটি ডলার এবং রোলিং স্টক ও অন্যান্য ফি বাবদ ১৩৭ কোটি ডলার। এদিকে বৃত্তাকার রেলপথ পরিচালনায় ২০৩৫ সালে খরচ হবে ৫১ কোটি ৪৭ লাখ ডলার ও ২০৫৫ সালে তা কমে দাঁড়াবে ৩৫ কোটি আট লাখ ডলার। আর বৃত্তাকার রেলপথে বিনিয়োগের জন্য বিল্ড ওন ট্রান্সফার (বিওটি) তথা পিপিপি প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
নির্মাণব্যয় বেশি হওয়ায় বৃত্তাকার রেলের ভাড়াও পড়ছে বেশি। এক্ষেত্রে ভিত্তি ভাড়া ধরা হয়েছে ৩০ টাকা ৬০ পয়সা, যা দিয়ে যাত্রীদের থেকে বিনিয়োগ তথা নির্মাণ ব্যয় তোলা হবে। এর সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া যুক্ত হবে তিন টাকা ৮০ পয়সা। যদিও নির্মাণাধীন উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলের ভাড়া প্রস্তাব করা হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে দুই টাকা ৪০ পয়সা। আবার এক্ষেত্রে কোনো ভিত্তি ভাড়াও নেই।
বৃত্তাকার রেলপথের নির্মাণব্যয় বেশি প্রসঙ্গে জানতে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান ও রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথে জমি অধিগ্রহণ ও আনুষঙ্গিক ব্যয় কম হবে। কিন্তু ঢাকায় এ ব্যয় অনেক বেশি। তাই ব্যয় বেশি হচ্ছে। তবে বৃত্তাকার রেলপথের ব্যয় উত্তরা-মতিঝিল রুটের মেট্রোরেলের তুলনায় কমই ধরা হয়েছে।