ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীর উড়ালসেতুগুলো ছবির বাঘ হয়ে না থাকুক

হাসান আদিল: রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অসহনীয় যানজট নিয়ন্ত্রণে ‘দাওয়াই’ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে উড়ালসেতু নির্মাণ। নির্মাণ শেষে ইতোমধ্যে কিছু উড়ালসেতু যানবাহন চলাচলের জন্য পূর্ণাঙ্গভাবে উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে; কিছু এখনও নির্মাণাধীন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবকাঠামোগুলো প্রত্যাশিত সাফল্য অর্থাৎ যানজট নিরসনে সহযোগী হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পরিকল্পনাটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত। আশা করা হয়েছিল, উড়ালসেতুগুলোই হবে যানজট নিরসনে মোক্ষম টোটকা। কিন্তু হলো কোথায়? রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি সম্পর্কিত সাম্প্রতিক এডিবির প্রতিবেদন দেখলেই বোঝা যায়, কতটা ক্ষতি আমাদের হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীতে যানজটের কারণে ক্ষতি হচ্ছে জিডিপির তিন শতাংশ। টাকার অঙ্কে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা।
যানজট থেকে দুই নগরবাসীকে মুক্তি দিতেই উচ্চাভিলাষী এ অবকাঠামোগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা। উড়ালসেতু নির্মাণের কারণে প্রশস্ত রাস্তাগুলো বরং সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। এর প্রেক্ষাপটে অবকাঠামোগুলোই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে যানজটের মূল কারণ। তাই নগরবাসীর মনে উড়ালসেতুগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে হাস্যরস, বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে নানা প্রশ্ন।
রাজধানীর বনানী হয়ে আসা ফার্মগেট কিংবা ধানমন্ডিগামী বাসগুলো উড়ালসেতু ব্যবহারে মোটেও উৎসাহী নয়। এর প্রধান কারণ, নিচ দিয়ে গেলে যাত্রী পাওয়া যায় বেশি। তাদের মতে, ‘উপর দিয়ে গেলে যে পরিমাণ যাত্রী বাসে থাকে, তাতে পোষায় না।’ যাত্রীদের শত আকুতি-অনুরোধের পরও উড়ালসেতুতে ওঠে না বাসগুলো লোকসানের ভয়ে। এ কারণে কমপক্ষে বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট সময় নষ্ট করে সে মহাখালী আমতলী হয়ে নিজেকে এবং যাত্রীদের দুটি সিগন্যালের ফাঁদে সঁপে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। লোকসান থেকে বাঁচতে এটা সে একপ্রকার বাধ্য হয়েই করে। এছাড়া যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদগামী বাসগুলোও এ উড়ালসেতুতে ওঠার সুযোগ পাওয়ার কথা নয়। কেননা এখান থেকে তেজগাঁওয়ের দিকে কোনো এক্সিট পয়েন্ট নেই। সুতরাং ভিন্ন দুটি গন্তব্যের গাড়িগুলো উড়ালসেতুর নিচ দিয়ে সংকুচিত হয়ে যাওয়া সড়ক ধরেই চলাচল করে সৃষ্টি করছে অসহনীয় যানজট। এ তো গেলো একটার কথা। বেশ কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, মেয়র হানিফ উড়ালসেতুতে টোল নিতে দেরি করার কারণেও তৈরি হচ্ছে যানজট। যানজটের কারণে ভোগান্তি তো আছেই, একই সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা। এই উড়ালসেতুতে টোল বেশি হওয়ার অভিযোগেও নিচ দিয়ে চলাচল করে বহু গাড়ি।
যানজট, যাত্রীদের ভোগান্তির ঘটনা শুধু ঢাকার উড়ালসেতুগুলোতে সীমাবদ্ধ নয় বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও একই অবস্থা। দক্ষিণ চট্টগ্রাম অভিমুখে ছেড়ে যাওয়া গাড়িগুলো বহদ্দারহাটে নির্মিত উড়ালসেতুতে উঠতে ইচ্ছুক নয়। নিচ দিয়ে গেলে তারা যাত্রী তুলতে পারে। এছাড়া যাত্রী ওঠানোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্থান না থাকায় বহদ্দারহাট এলাকায় যানজট যেন ললাট লিখন। আটকে থাকা কিংবা থেমে থেমে চলা বাস, মিনিবাস, টেম্পো, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত থ্রি হুইলার ও রিকশা টপকে গন্তব্যে পৌঁছতে পোহাতে হয় তীব্র ভোগান্তি। একই সঙ্গে বর্তমানে উড়ালসেতুতে ছিনতাইয়ের ঘটনা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে। একে তো উড়ালসেতুতে গাড়ি উঠছে না, তার ওপর নিরাপত্তা ঝুঁকি। সব মিলিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রমটি হারিয়েছে যৌক্তিকতা। ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি আনতে নির্মিত উড়ালসেতুগুলো এখন উল্টো যানজটের ফাঁদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন নাগরিকদের মনে প্রশ্ন দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। যানজট নিরসনের জন্যই তো কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে উড়ালসেতু বানানো হয়েছে। সৌন্দর্য বাড়ানো কিংবা স্থাপত্য নিদর্শন নয়; বরং এগুলোর প্রধান কাজ হওয়ার কথা ছিল যানজট নিরসন; কিন্তু হয়নি। হয়েছে হিতে বিপরীত। সম্প্রতি বুয়েটের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীর উড়ালসেতুগুলোর সুবিধা অধিকাংশ নাগরিক পাচ্ছেন না। এতে যে পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছে তা হলো, স্বাভাবিক সময়ে রাজধানীতে দৈনিক দুই কোটির বেশি ট্রিপ (যাতায়াত) হয়। এর মধ্যে ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ হয় রিকশায়, ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ বাসে ও ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ হেঁটে। এ হিসাব অনুযায়ী, ৮৬ দশমিক ৪ শতাংশ যাতায়াতকারী কোনোভাবেই উড়ালসেতুর সুবিধা পায় না। বরং এ কারণে সংকুচিত হয়ে আসা রাস্তায় যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। এর বাইরে রাজধানীবাসীর ৬ দশমিক ৬ শতাংশ যাতায়াত করে অটোরিকশা ও ৫ দশমিক ১ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়িতে। এর মধ্যে মূলত উড়ালসেতু ব্যবহার করে কিছু ব্যক্তিগত গাড়ি ও অটোরিকশা; মোট ট্রিপের যা মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ রাজধানীর ৯৫ শতাংশ ট্রিপে উড়ালসেতুর কোনো ব্যবহার নেই। ভবিষ্যতেও রাজধানীর যানজট নিরসনে উড়ালসেতুগুলোর ভূমিকা রাখার সুযোগ খুব একটা নেই বললে চলে। কারণ ২০২৫ সালে ঢাকার জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় আড়াই কোটি। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে ট্রিপসংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে দৈনিক প্রায় সাড়ে ৬ কোটিতে। এর মধ্যে রিকশা ও বাসে ট্রিপ হবে প্রায় ৪ কোটি এবং পায়ে হেঁটে ১ কোটি। আর ৭০ লাখ ট্রিপ হবে ব্যক্তিগত গাড়ি ও ৬৬ লাখ অটোরিকশায়।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়, বিভিন্ন ধরনের বাহনের মধ্যে সবচেয়ে কম যাত্রী পরিবহন করে ব্যক্তিগত গাড়ি। কারণ ঢাকায় একটি রিকশা যাত্রী পরিবহন করে গড়ে ১ দশমিক ৬ জন, ব্যক্তিগত গাড়ি ১ দশমিক ৫ ও বাস ৫২ জন। অর্থাৎ একটি বাসের সমান যাত্রী পরিবহনে দরকার ৩৫টি ব্যক্তিগত গাড়ি।
গণপরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়নে ২০০৬ সালের মহাপরিকল্পনায় রাজধানীতে তিনটি মেট্রোরেল ও তিনটি বিআরটি চালুর কথা বলা আছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি মেট্রোরেল ও একটি বিআরটির কাজ শুরু হয়েছে। তবে তা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। বাকিগুলো এখনও রয়ে গেছে পরিকল্পনাতে।
বুয়েটের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তিগত গাড়িতে যাতায়াতের পরিমাণ খুব বেশি নয়। অধিকাংশ নগরবাসীর অবলম্বন গণপরিবহন। কিন্তু গণপরিহন ব্যবস্থা পড়ে আছে এখনও পুরোনো আমলে। এর উন্নয়নে নেওয়া হচ্ছে না কোনো আধুনিক প্রকল্প। মেট্রোরেল ও বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পগুলো শুরুর দোরগোড়ায় বলা চলে। এগুলোর প্রয়োজন ছিল হালি হালি উড়ালসেতু নির্মাণের আগে। উড়ালসেতুগুলো গুটিকয় অভিজাত নগরবাসীর সুবিধার্থে নির্মিত হলেও গন্তব্যের মারপ্যাঁচে ভোগান্তিতে পড়ছেন তারাও। এর অর্থ দাঁড়ায়, যত্রতত্র উড়ালসেতু নির্মাণের এ দৃষ্টিভঙ্গি আদতে নাগরিকদের সার্বিক কল্যাণে আসছে না। সুবিধাগুলো গিয়ে জমা হচ্ছে মুষ্টিমেয় নাগরিকের পকেটে। বলতে গেলে উচ্চাভিলাষী অবকাঠামোগুলো কিছু ব্যক্তিগত গাড়িমালিকের সুবিধা করে দিয়েছে। এতে যানজট কমেনি, উল্টো বেড়েছে। এখন পর্যন্ত গণপরিবহন দূরের কথা, পরিকল্পিত বাস নেটওয়ার্কও গড়ে ওঠেনি নগরীতে। যে কারণে সড়কে হামেশা জট লেগেই থাকে।
বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে একেবারে নীরব নন। তাদের কথায় ফুটে ওঠে উড়ালসেতুর অযৌক্তিক নির্মাণ নিয়ে চাপা ক্ষোভ। এতে আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। তারা মনে করছেন, সাধারণের কাজে না আসা এ অবকাঠামোগুলো প্রকৃত অর্থে যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখছে না। বরং ব্যক্তিগত গাড়িনির্ভর অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনার কারণে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে গণপরিবহন ব্যবস্থা। এমনকি গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের স্বার্থে একসময় না একসময় এ অবকাঠামোগুলো ভেঙে ফেলতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। বাস্তবতার নিরিখে দেখা যাচ্ছে, উড়ালসেতুগুলো আসলে যানজট নিরসনে যতটা ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হয়েছিল, তা পারছে না। অবকাঠামোগুলো উম্মুক্ত হওয়ার পর থেকে ধরা পড়ছে পরিকল্পনার খুঁত। যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখতে না পারার মূল কারণ হচ্ছে, উড়ালসেতুগুলো গণপরিবহনবান্ধব নয়। যেমন, তেজগাঁওর সাতরাস্তা হয়ে উড়ালসেতুটি হাতিরঝিল অংশের যানজট কমাতে বহুলাংশে সাহায্য করেছে। এমনকি সুফল মিলেছে কুড়িল বহুমুখী উড়ালসেতুর ক্ষেত্রে। সেই সঙ্গে যদি নিয়মিত বনানী হয়ে আসা ধানমন্ডি-মতিঝিলগামী গণপরিবহনগুলোকে মহাখালী উড়ালসেতুতে উঠতে বাধ্য করা যায়, তাহলে সেখানেও যানজট কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে উড়ালসেতুগুলোকে গণপরিবহনবান্ধব করার পাশাপাশি উন্নত করতে হবে ট্রাফিক ব্যবস্থা। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধ, যাত্রী ওঠানামার জন্য নির্দিষ্ট স্থান করে দেওয়া সময়ের দাবি। কেউ অমান্য করলে শাস্তির বিধানও রাখা যেতে পারে। এখন পরিকল্পনাবিদদের খুঁজে বের করতে হবে, বিপুল ব্যয়ে নির্মিত অবকাঠামোগুলোকে কীভাবে সর্বোচ্চ পরিসরে গণপরিবহনবান্ধব করা যায়। কাজে লাগানো যায় যানজট নিরসনে। অন্যথায় ছবির বাঘ হয়ে থাকাটাই হবে এগুলোর নিয়তি!

শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক

hasanadil1991Ñgmail.com