রবিউল আলম প্রধান: প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষায় দেশের বৃহৎ ও প্রথম বিদ্যাপীঠ। ব্রিটিশ শাসনামলে অবহেলিত জনপদগুলোর মধ্যে অন্যতম পূর্ব বাংলা। মুসলিম অধ্যুষিত এ অঞ্চলে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পিছিয়ে ছিল আজকের এই বাংলাদেশ। ফলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয় বাংলার মানুষ। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ আনুষ্ঠিকভাবে ঘোষণা করার পর বাংলার মানুষ বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্রিটিশবিদ্বেষী মনোভাব তীব্র আকার ধারণ করে। বাংলার বিভক্তি রদ হয়ে যাওয়ার ফলে জনগণের মধ্যে যে অসন্তোষ দেখা দেয়, তা সরজমিনে দেখার জন্য তৎকালীন বড় লাট লর্ড হাডিঞ্জ ১৯১২ সালে পূর্ব বাংলায় আসেন। তখন নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, এ কে ফজলুল হক-সহ বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক বড় লাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে এই অঞ্চলে শিক্ষাদীক্ষা চরমভাবে পিছিয়ে পড়ে, ফলে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করেন। বড়লাট প্রস্তাবটি মেনে নেন এবং ওই বছর একটি সরকারি ঘোষণায় প্রস্তাবটি পাস হয়।
১৯১২ সালে ব্যারিস্টার নাথানের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার রিপোর্ট পেশ করেন। ১৯১৩ সালে নাথান কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয় এবং একই বছর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক রিপোর্টটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দোহাই দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়।
১৯১৭ সালে ৭ মার্চ নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ভারতীয় বিধান সভায় বিষয়টি আবার উপস্থাপন করলে সরকার এ ব্যাপারে পূর্ণ আশ্বাস প্রদান করে এবং ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড জেম্স ফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা ও চাহিদা নির্ধারণ করার লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করেন। ১৯১৯ সালে ড. এমই স্যাডলারের নেতৃত্বে স্যাডলার কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন তার প্রতিবেদনে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যথার্থতা স্বীকার করে। ১৯১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা পরিষদে পেশ হয় এবং ১৯২০ সালে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। একই বছর ভারতীয় বিধান সভায় গৃহীত বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় শুরুতে তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ শিক্ষক, তিনটি আবাসিক হল ও ৮৭৭ ছাত্রছাত্রী নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটা জাতির বিবেক ও অভিভাবক। জাতির যে কোনো সংকটকালে পাশে দাঁড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তরণ ঘটিয়েছে সমস্যার। সময়ের আবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজ আমলের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, বাংলাদেশ আমলে ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ’৯০-এর গণ-আন্দোলন এবং ১৯৯৬ সালের গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোল এবং যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলনে ভূমিকা রাখে।
১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫তম সমাবর্তনে বাঙালি ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ কখনই নিছক যুক্তিবিদ বা সংকীর্ণমনা বিশেষজ্ঞ তৈরি করা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করবে এমন যোগ্য নেতা, যিনি যে কোনো সমস্যার সামগ্রিক চিত্র উপলব্ধি করতে পারেন এবং সবাইকে নিয়ে তা সমাধানের সমন্বিত পন্থা আবিষ্কার করবেন।’
১৯৩৮ সালে ১৭তম সমাবর্তনে আরসি মজুমদার লিখলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শুধু স্কুল-কলেজের পরবর্তী ধাপ নয়, মানুষকে জানাতে হবে যে, বিশ্ববিদ্যালয় কারিগরি শিক্ষাদানের কোনো স্থানও নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে; সেগুলো হলো জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান অনুসন্ধানের মাধ্যম শিক্ষার অগ্রগতি নিশ্চিত করা, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো।’
১৯৪০ সালে ১৯তম সমাবর্তনে ইতিহাসবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ এ এফ রহমান বলেন, ‘এ বিশ্ব মঙ্গলের জন্য নিরাপদ সমাজ গঠনের জন্য সবসময় তরুণদের আত্মত্যাগ চায়। কিন্তু আমি বলব, প্রথমে নিজের মতাদর্শ গঠন করো। আগে আত্মবিশ্বাসী হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শেখো। অন্যকে অনুসরণ করে নয়, বরং নিজের সিদ্ধান্ত, নিজের মতামত নিজেই গড়ে তোলো।’
১৯৭০ সালে ৪১তম সমাবর্তনে রসায়নবিদ, গ্রন্থকার ও শিক্ষাবিদ কুদরাত-এ-খুদা বলেন, ‘জীবনে যা কিছু তাকে সম্পাদন করতে হবে, তাও তাদের এই যোগ্যতার ওপর নির্ভর করবে।’
আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০০তম বর্ষ পূর্ণ করতে চলেছে। বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যজুড়ে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদচারণা ও অবদান। জাতির যে কোনো ক্রান্তিকালে দেবদূতের পাশে পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম এবং ১০০ বছরের ইতিহাস মনে করিয়া দেয় তার অবদানের কথা, ভূমিকার কথা, দায়িত্ববোধের কথা। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ শাসনামলে, পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তার অভিভাবকদের ভূমিকা দেখতে পাই। ১৯৯৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই অক্সফোর্ড-খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টির তেমন কোনো ভূমিকা উল্লেখ করার মতো চোখে পড়ে না। তাহলে কি আমাদের আর কোনো সমস্যা নেই? না বিশ্ববিদ্যালয় আর নেতৃত্বে তৈরি করতে পারছে না?
যদি আমাদের কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে আমরা উন্নত জাতি-গোষ্ঠীতে পৌঁছে গেছি। আর যদি নেতৃত্বে তৈরিতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে অনিশ্চিত কোনো সময়।
সাবেক ছাত্র
সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়