ইসমাইল আলী: বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়ক হচ্ছে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন। অথচ প্রকল্পটির পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করা হয়নি। প্রকল্পটির নেই কোনো পরিবেশগত পর্যবেক্ষণ পরিকল্পনা (ইএমপি)। ভূগর্ভস্থ পরিষেবা সংযোগ লাইন স্থানান্তরে নেই কোনো মাস্টারপ্ল্যান। এছাড়া প্রকল্পটির প্রাথমিক পরিকল্পনায়ও ভুল ছিল। এসব কারণে নির্মাণ শুরুর দুই বছরের মাথায় দ্বিতীয় দফায় প্রায় ৫৪ শতাংশ ব্যয় বাড়ছে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন নির্মাণে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদেন এ তথ্য উঠে এসেছে। ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় কম ধরার যুক্তিতে এর আগে প্রথম দফায় প্রায় ১০ শতাংশ ব্যয় বাড়ানো হয়েছিল প্রকল্পটির।
তথ্যমতে, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন উন্নীতকরণ প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয় ২০১৬ সালের মে মাসে। সে সময় এর ব্যয় ছিল ছয় হাজার ২৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। যদিও অনুমোদনের ছয় মাসের মধ্যেই এ ব্যয় বাড়ানো হয় আরও ৬০০ কোটি টাকা। আর দুই বছর না যেতেই প্রকল্পটির পরিকল্পনায় ভুল ধরা পড়ে। এতে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হচ্ছে ১০ হাজার ৫৪২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বাড়ছে তিন হাজার ৬৯০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বা ৫৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবটি এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এতে প্রকল্পটি পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি। সম্প্রতি এর প্রথম খসড়া নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। পরে প্রতিবেদনটির বিষয়ে মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের জন্য অতি প্রয়োজনীয় হলেও ইআইএ করা হয়নি ও ইএমপিও নেই। ভূগর্ভস্থ পরিষেবা সংযোগ লাইন স্থানান্তরে কোনো মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় কাজে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। এজন্য প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ছে, ফলে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন করতে হচ্ছে। এছাড়া প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা জমি ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করেছে, যা প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এক বছর রক্ষণাবেক্ষণ করবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। এর পর প্রকল্পটি সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পরে রক্ষণাবেক্ষণের বেসরকারি সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তা না হলে দ্রুত এ সড়ক নষ্ট হয়ে যাবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ডিপিপি সংশোধনের প্রস্তাবে নতুন কিছু কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজউক কর্তৃক নির্মিতব্য শান্তিনগর-ঝিলমিল ফ্লাইওভারের সঙ্গে সংগতি রেখে দুই হাজার ৩৩৩ মিটার তেঘরিয়া-বাবুবাজার ফ্লাইওভার নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। ভাঙ্গা-ফরিদপুর অংশে নির্মিতব্য ইন্টারচেঞ্জ ক্লোভার লিফের র্যাম্পের অ্যালাইনমেন্টের সঙ্গে সমন্বয় করে কুমার ব্রিজ ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। টোল প্লাজার ডিজাইন পরিবর্তনসহ এর সঙ্গে রেস্তোরাঁ, অফিস ও বাসস্থান, পাম্প হাউজ, নির্বাপণ কেন্দ্র, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন, পানির ট্যাংক, পুলিশ পোস্ট অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এ খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে।
এর বাইরে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী রেলওয়ে ওভারপাসের উচ্চতা বাড়ানোয় এর দৈর্ঘ্য দুই দশমিক ৮০ কিলোমিটার থেকে চার দশমিক ৪৪৪ কিলোমিটার হয়ে গেছে। সড়কের মাটির গুণাগুণ খারাপ হওয়ায় ও সড়কের উভয় পাশে অনেক পুকুর, জলাশয় ও নিচু ভূমি থাকায় এবং অতিবৃষ্টিতে বন্যায় সড়কের নতুন এমব্যাংকমেন্ট রক্ষার জন্য সড়কের উভয় পাশে প্রচুর পরিমাণে রক্ষাপদ কাজের পরিকল্পনা নিতে হয়েছে।
এদিকে প্রকল্প এলাকায় বিদ্যমান কয়েকটি সেতু ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে হচ্ছে। এতে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সড়কের বিভিন্ন জায়গায় ডাইভারশন রোড নির্মাণ করতে হচ্ছে, যা আগের ডিপিপিতে ছিল না। প্রকল্পের কাজ দ্রুত করতে অ্যালাইনমেন্টের মধ্যে বিভিন্ন সংস্থার ইউটিলিটিগুলো পুনঃস্থাপন ব্যয়ও ডিপিপি অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে।
জানতে চাইলে সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, নির্মাণ শুরুর সময় কিছু বিষয় ছিল না, যা পরে যুক্ত হয়েছে। এতে প্রকল্পটির কাজের পরিধি বেড়ে গেছে। এছাড়া জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বাড়াতে হয়েছে। এজন্য খাতটির ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যয়ও বাড়ছে। আর আয়কর, ভ্যাটসহ নতুন কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে। মাটির সক্ষমতা বাড়াতে হয়েছে। পাশাপাশি নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় তার ব্যয় নতুন করে প্রকল্পটিতে যুক্ত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা ৫৫ কিলোমিটার চার লেন নির্মাণ প্রস্তাবটি সংশোধন করা হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। এতে প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়ায় ছয় হাজার ৮৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ছিল ১২৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হিসেবে এটি বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এবার প্রকল্পটির ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ১০ হাজার ৮৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বাড়ছে তিন হাজার ২৩২ কোটি ৩২ লাখ টাকা বা ৪৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ১৮৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যয়বহুল মহাসড়কটি আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে।