Print Date & Time : 13 September 2025 Saturday 1:57 am

তফসিল ঘোষণায় বিরোধী শিবিরের প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক সমঝোতার সুযোগ

আলী ওসমান শেফায়েত: গত ২৮ অক্টোবরের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পূর্বাপর বোঝা গিয়েছিল, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে যাবে। নির্বাচন কমিশন একটি নির্দিষ্ট সময়ে তফসিল ঘোষণা করবে। নভেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে ঘোষণা করা হবে এমন আভাস ছিল। এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন আরও নিশ্চিত হওয়া যায়, অচিরেই ঘোষণা হবে তফসিল। সেই অনুমান সঠিক করে ১৫ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানালেন, আগামী ৭ জানুয়ারি রোববার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও অন্যান্য আরও কয়েকটি দল যুগপৎ আন্দোলন করে আসছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই কমিশন থেকে জানানো হয়েছিল ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। কারও বুঝতে বাকি ছিল না যে তিনি তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। ফলে তার ভাষণের আগেই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ পূর্বঘোষণা অনুযায়ী বিশাল গণমিছিল নিয়ে নির্বাচন কমিশনের দিকে যাত্রা করে। পথে পুলিশের ব্যারিকেড পর্যন্ত এসে শান্তিনগর মোড়ে শান্তিপূর্ণ পথসভা করে তারা ফিরে যায়। অবশ্য এ দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। হয়তো অংশগ্রহণও করত, কিন্তু বরিশালে স্থানীয় নির্বাচনে দলের নায়বে আমিরের ওপর নগ্ন হামলা ও নির্বাচন-পরবর্তী সরকারি দল ও প্রশাসনের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদের কারণে তাদের সরকারবিরোধী মনোভাবে আরও খানিকটা কঠোর হয়ে ওঠে। তারাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে যাচ্ছে।

তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি। মূলত তাদের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছেÑএই নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য হবে। এদিক দিয়ে বিএনপি একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তফসিল ঘোষণা হলেও এখনও সংলাপ হতে পারে। তফসিল পাল্টে পুনঃতফসিল ঘোষণারও আইনগত সুযোগ আছে। বিগত দিনের একাধিক নির্বাচনে একাধিকবার পুনঃতফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জানিয়েছেন, ‘এখানে তাদের কোনো রাজনৈতিক পক্ষ নেই, তারা চান নিরপেক্ষ নির্বাচন। তফসিল ঘোষণার ঠিক আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠি তিনি বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই চাওয়া যুক্তিসংগত এবং এর সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ধারণা আছে, যুক্তরাষ্ট্র সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আড়ালে সরকার পরিবর্তন দেখতে চাচ্ছে। এটা সরকারে থাকা দল আওয়ামী লীগও বিশ্বাস করে।

তফসিল ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে মানুষের মধ্যে এমন ধারণাও আছে, যুক্তরাষ্ট্র ইঙ্গিত দিলেই বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনে আসবে। হয়তো তারা সরকারকে কিছু শর্ত আরোপ করতে পারে।

তৃতীয় বৃহৎ দল জাপার মহাসচিব এরই মধ্যে বলেছেন, তফসিল ঘোষণা হলেও এখনও তারা সমঝোতার আশা ছাড়েননি। অর্থাৎ সব দলের অংশগ্রহণই তাদের প্রত্যাশা বলে ব্যক্ত করতে চেষ্টা করেছেন; কিন্তু লাভ-ক্ষতির কথা চিন্তা করলে জাতীয় পার্টি আনঅফিশিয়ালি আশা করতে পারে, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও কৌশল কী, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এই দলের মধ্যে আছে ভিন্ন ভিন্ন মত।

এখন সামনের কয়েকটি দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি দূতাবাসগুলো অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রাখবেÑনির্বাচন কমিশন কতটা আইনগত এখতিয়ার পালন করে এবং করতে পারে। তফসিল ঘোষণার পর বাংলাদেশের সংবিধানের ১২৬ ধারা অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের বিশেষ ক্ষমতা তৈরি হয় প্রশাসন তথা দেশ পরিচালনার ওপর। সরকারে যারা থাকেন, তারা কোনো নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন না। কেবল রুটিনওয়ার্ক চালিয়ে যাবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার উল্লেখ আছেÑ‘নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন যদি চায় কোনো জেলা প্রশাসককে, কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বা অন্য কাউকে সরিয়ে দিতে এবং অন্য কাউকে সেখানে পদায়ন করতে, তাহলে সেটা সরকার করতে বাধ্য থাকবে। এটা ঠিক, বিগত দুই নির্বাচনে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তাই এবার যদি দেখা যায়, নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট রদবদল করছে না, অথবা রদবদলের সুপারিশ করলেও তা মানা হচ্ছে না, তাহলে এই নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণা অনেকটাই অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। আর যদি এখন থেকে নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড এবং সরকারের যথেষ্ট সদিচ্ছা পরিলক্ষিত হয়, তাহলে সামনের কয়েক দিনের মধ্যে রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নিতে পারে। জনগণও বিশ্বাস করে, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা বিএনপিকে জোরালোভাবে অনুরোধ করলে তারা নির্বাচনে চলে আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু যে শর্তহীন সংলাপের পরামর্শ দিয়েছেন, তা কার্যকর হয়ে উঠবে।

বিগত দিনে আমরা দেখেছি, সাধারণত তফসিল ঘোষণার ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর নির্বাচন ঘোষণা করা হয়। এবার মোটামুটি ৫৩ দিন পর নির্বাচনের তারিখ দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২৯ জানুয়ারি। অর্থাৎ আরও কয়েক দিন সময় আছে রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নেয়ার। নির্বাচন কমিশনারও চাইবেন, তার কমিশনের যাতে একটি গ্রহণযোগ্যতা থাকেÑভবিষ্যতে যেন একটি কলঙ্কিত কমিশন হিসেবে তার ওপর দায়িত্ব না বর্তায়। যদিও বর্তমানে অনেকে নির্বাচন কমিশনকে ইন্তেকাল কমিশন বলতে অত্যধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন, তাই তিনি আগে থেকেই বলেছেন, ‘দুটি দল, পাঁচটি দল, ১০টি দল ও ছোটখাটো দল বাংলাদেশের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। তবে এটা অনস্বীকার্য, মূল বিরোধী দল যে বিএনপি, তাদের সমকক্ষ ওরা নয়। এটা আমরা অস্বীকার করি না বা কেউ অস্বীকার করবে না। ওই দলটি যদি অংশগ্রহণ না করে, তাহলে একটা অনিশ্চয়তা বা একটা শঙ্কা থেকে যেতে পারে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ তার এই কথার মধ্যেই আছে, তিনি বিএনপির অংশগ্রহণ চাইছেন। বিএনপি মনে করছে, এই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেন, যে কোনো প্রধান নির্বাচন কমিশনারই সরকারের আদেশ-নির্দেশের বাইরে যেতে পারবে না। তাই তারা কোনো নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচনে না গিয়ে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে। সুতরাং প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা কমিশনের যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্নটি গৌণ।

তবে সরকার যদি আন্তরিকতার সঙ্গে চায়, একটি সত্যিকার ফলপ্রসূ নির্বাচন অনুষ্ঠানের, তাহলে সংলাপের ব্যাপারে অনিচ্ছা প্রদর্শন করা মোটেই সমীচীন হবে না। সেইসঙ্গে আগামী কয়েক দিন নির্বাচন কমিশনের সুপারিশগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করাটা শুধু সাংবিধানিক দায়িত্বই হবে না, সেই সঙ্গে একটি বিশ্বস্ততাও তৈরি করবে বিভিন্ন মহলে। তাতে বিএনপির নির্বাচনে আসার একটি পথ তৈরি হতে পারে।

বিএনপির কাছেও ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক দাবির বাইরে কোনো বিকল্প নেই, তা নয়। যেমন বিএনপি প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্রে বিদেশি পর্যবেক্ষকের উপস্থিতির দাবি জানিয়ে নির্বাচনে আসতে পারে। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণাকালে পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষক উপস্থিত রাখার দাবিও করতে পারে; কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা সেসব পথে যায়নি। সামনে আরও কয়েক দিন সময় আছে। প্রতিদিন নতুন নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, এটা ধরে নেয়া যায়। সুতরাং দেখা যাক।

শিক্ষক ও মুক্ত লেখক

কুতুবদিয়া, কক্সবাজার