তরুণ প্রজন্ম ধ্বংসের অশনি সংকেত!

একটি দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি অর্জনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র তারুণ্যশক্তি। পৃথিবীর যত মহৎ কর্ম সাধিত হয়েছে, মুক্তির উদ্যম হাওয়া যত প্রান্তর বেয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তার প্রত্যেকটির পেছনে অসামান্য অবদান রয়েছে তরুণদের। অথচ আজ সেই তরুণ প্রজন্মকেই সুকৌশলে ধ্বংস করা হচ্ছে মাদক তথা প্রাণঘাতী ইয়াবার আগ্রাসনে।

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে দেশে মাদক হিসেবে ইয়াবা সেবন চললেও ২০০২ সালের দিকে তা ধরা পড়ে। যদিও শুরুর দিকে এ নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না প্রশাসনের, সেই ইয়াবাই এখন মাথাব্যথার বড় কারণ। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আনাচকানাচেও পৌঁছে গেছে জীবনঘাতী এই ইয়াবা। সারাদেশে যেভাবে বাড়ছে ইয়াবাকারবারিদের শক্তিশালী তৎপরতা, তাতে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। সূত্র বলছে, বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ইয়াবা ঢুকছে সীমান্ত দিয়ে। ড্রাগ অ্যান্ড ক্রাইমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাদকাসক্তদের ৬৮ শতাংশই এখন ইয়াবাসেবী। এই আসক্তদের সিংহভাগই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অর্থাৎ দেশের মেধাবী তরুণ প্রজন্ম।

প্রথমে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের টার্গেট করে ছড়িয়ে দেয়া হয় এই মারণ নেশা। পরবর্তীকালে নকল ইয়াবা তৈরি করে দাম কমিয়ে উচ্চবিত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্ত তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও ইয়াবার বিস্তার ঘটে। তরুণ প্রজন্মর মাঝে ইয়াবাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে মূল উপাদান এমফিটামিনের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে আঙ্গুর, কমলা ও ভ্যানিলার ফ্লেভার। লাল-কমলা রঙের এ ট্যাবলেটটি দেখতে ও খেতে অনেকটা ক্যান্ডির মতো। ইয়াবা সেবনে ক্ষুধা কমে যায় বলে বেশিরভাগ তরুণী এটি সেবন করে স্লিম হওয়ার ওষুধ হিসেবে। কিন্তু তরুণ-তরুণীরা এর ক্ষতিকর প্রভাব বুঝে ওঠার আগেই আসক্ত হয়ে পড়ছে। সংগত কারণেই এই মাদকাসক্ত তরুণরা ভয়াবহ ইয়াবার বিষক্রিয়ার মিশ্রণে আক্রান্ত হয়ে নিজেদের মূল্যবান জীবনটা শেষ করে দিচ্ছে, যার প্রচ্ছন্ন প্রভাব আমরা দেখতে পাই সমাজের নানা অপকর্মে কিংবা অসামাজিকতায়।

আগুনের ওপর ঘি ঢেলে আগুনকে যেমন তীব্র থেকে তীব্রতর করা হয়, তেমনি তরুণ প্রজš§কে আরও শক্তিশালীভাবে ধ্বংস করতে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে প্রবেশ করছে মাদকের জগতে নতুন আমদানি এলএসডি! এলএসডির অর্থ হলো, লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড। এই অ্যাসিড এক ধরনের সাইকেডেলিক ওষুধ, যা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের জন্য পরিচিত। এটি প্রধানত প্রমোদমূলক ওষুধ হিসেবে ও আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এলএসডি সাধারণত জিভের নিচে রেখে ব্যবহার করা হয়। এই অ্যাসিড প্রায়ই বল্টার কাগজ, চিনির কিউব, বা জিলেটিনে বিক্রি করা হয়। এলএসডি স্বচ্ছ ও গন্ধহীন একটি পদার্থ। এটি পাউডার, তরল, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের আকারে পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের মতে, এলএসডিকে সাইকেডেলিক মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ধরনের মাদকের প্রভাবে মানুষের মতিভ্রম ঘটে। আশেপাশের পরিবেশ ও বাস্তবতাকে মুহূর্তেই ভুলে গিয়ে তারা অলীক বস্তু প্রত্যক্ষ করতে থাকে।

একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে কতিপয় অসাধু ব্যক্তির অনৈতিক কার্যকলাপে সম্ভাবনাময় প্রজš§ ধ্বংসের সর্বশেষ ধাপে নেমে আসবে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মাদকের আগ্রাসন থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে প্রয়োজন সামগ্রিক প্রতিরোধ। তরুণদের এ অবস্থা উত্তরণে বর্তমান সমাজের নীতিনির্ধারকদের ভাবা জরুরি। প্রতিবেশী দেশ থেকে যেসব সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে এবং ঢোকার আশঙ্কা রয়েছে, সেসব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। নতুন মাদক আইস, এলএসডি সম্পর্কেও যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে।

এলএসডি আপাতত কম ছড়ালেও এর বিস্তার ধ্বংস না করা, কিংবা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ইয়াবার মতো এলএসডির আগ্রাসনও থামানো কষ্টকর হবে। ইয়াবা ও এলএসডির কুফল সম্পর্কে সবাইকে বিশেষত উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীদের সচেতন করতে হবে। একই সঙ্গে জোরদার করতে হবে সামাজিক আন্দোলন। যারা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সেসব প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করা যেমন বিশেষ প্রয়োজন, তেমনিভাবে আইনি ব্যবস্থাপনাকেও আধুনিক ও শক্তিশালী করার জন্য সংশ্লিষ্টদের সচেতন দায়বদ্ধতা রয়েছে। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মূল্যবান সময় ও জীবনকে সুরক্ষা দিতে সব ধরনের প্রাসঙ্গিক কার্যক্রমও বিশেষ জরুরি।

অভিভাবকদেরও সচেতন হওয়া জরুরি। আপনার সন্তানকে সুশিক্ষা দেয়া আপনারই দায়িত্ব। তার দেখভাল আপনাকেই করতে হবে। পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশিক্ষাই পারে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের সুপথে পরিচালিত করতে।

তারুণ্যের শক্তির আশ্রয়ে পৃথিবীকে বদলে দিতে প্রয়োজন তরুণদের সঠিক পথে চালিত করার দিকনির্দেশনা। তরুণদের শুভশক্তির দ্যুতি ছড়িয়ে মহৎ এক পৃথিবীর উদ্ভব ঘটাতে তরুণদের চালিত করতে হবে আলোর পথে, মুক্তির পথে।

শাহিন আলম

শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়