Print Date & Time : 5 July 2025 Saturday 11:40 am

তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতাদের লাইসেন্স গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা জরুরি

সৈয়দা অনন্যা রহমান: জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের ৮০ শতাংশ অকাল মৃত্যু ঘটে অসংক্রামক রোগের কারণে। প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি লোক অসংক্রামক রোগের কারণে মারা যায়, যা বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৭১ শতাংশ। অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, ধূমপান ও তামাক ব্যবহার, মদ বা অ্যালকোহল সেবন এবং বায়ূদূষণ এই পাঁচটিকে অসংক্রামক রোগের মূল কারণ। বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর মৃত্যুবরণ করে প্রায় ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষ। ধূমপানে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। এই ব্যাপক হারে তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির অন্যমত কারণ এসব পণ্যের সহজ প্রাপ্যতা এবং সহজলভ্যতা। তামাক কোম্পানিগুলো সারা দেশেই তরুণদের টার্গেট করে জনসমাগমস্থলে গড়ে তুলছে বিক্রয়স্থল। বর্তমানে মুদি দোকান, রাস্তার পাশের টং দোকান থেকে শুরু করে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেও অবাধে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করা হচ্ছে।

কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সারাদেশে এ তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের দোকানের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সহজ প্রাপ্যতা ও সহজ লভ্যতার জন্য এসব এলাকায় অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশের দোকানগুলো থেকে তরুণ শিক্ষার্থীরা সহজেই তামাকজাত দ্রব্য কিনতে পারছে। যা তাদের ধূমপানে আসক্ত এবং উৎসাহী করে তুলছে। পাশাপাশি রয়েছে হকারদের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ তামাক পণ্যের বিক্রয় ব্যবস্থা। অনিয়ন্ত্রিতভাবে যত্রতত্র তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থল গড়ে ওঠায় এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে। স্বাস্থ্যহানিকর এসব পণ্যের অবাধ বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ব্যবহার কমানো সম্ভব নয়। আর ব্যবহার কমানো না গেলে মহামারি আকারের অকাল মৃত্যু এবং অসুস্থতার হারও কমানো সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বৈধ কিন্তু যে কোনো ক্ষতিকর পণ্য নিয়ন্ত্রণে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
ক্ষতিকর পণ্য নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন, আইন বাস্তবায়ন, কর বৃদ্ধির পাশাপাশি লাইসেন্স প্রদান কার্যকর পন্থা হিসেবে স্বীকৃত। তামাক নিয়ন্ত্রণে স্বার্থেই তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্তদের তালিকাভুক্ত করা প্রয়োজন।

জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সরকার ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’ প্রণয়ন করেছে। ওই নির্দেশিকার ৮(১) অনুসারে, তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে হলে বিক্রেতাকে স্বতন্ত্র লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে কোনো লাইসেন্স প্রদান করা যাবে না। লাইসেন্স/নিবন্ধন ব্যবস্থা তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় সীমিত করার মাধ্যমে ব্যবহার কমাতে সহায়তা করে। এই ব্যবস্থা কার্যকর করা হলে সারাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের দোকান এবং ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হবে এবং এদের পুনর্বাসনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে। নিবন্ধন এর আওতায় আনা হলে তামাক বিক্রয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হকাররা বেকার হয়ে যাবে বলে তামাক কোম্পানিগুলো যে প্রচারণা চালাচ্ছে তা সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে এসব হকারদের অস্বাস্থ্যকর পণ্য বিক্রয় থেকে সরিয়ে এনে স্বাস্থ্যকর ও বিকল্প পণ্য বিক্রয়ে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।

ফ্রান্স, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, নেপাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’ অনুসারে বাংলাদেশেও প্রায় ৪০টির বেশি পৌরসভায় লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি নিয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা তামাক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের ব্যবস্থা কার্যকর করার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। বিভ্রান্তকর তথ্য দিয়ে নীতি নির্ধারকদের প্রভাবিত করতে চায়। বাংলাদেশেও বিগত দিনে ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা’ প্রণয়নের সময় তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপের দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা গেছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতাদের লাইসেন্সিং ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি শক্তিশালী করা জরুরি। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলো নিবন্ধনের প্রথা প্রচলনের বিষয়টিকে ভুল ব্যাখা দিয়ে আইনে অন্তর্ভুক্তকরণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, যা জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকারের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রচেষ্টার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুতরাং জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতাদের লাইসেন্স/নিবন্ধন গ্রহণ বাধ্যতামূলক এর বিধান অন্তর্ভুক্ত করে আইনটি শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী