সংবাদ সম্মেলনে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা

তামাকে নির্দিষ্ট করারোপে বিনামূল্যে হৃদরোগীদের চিকিৎসা সম্ভব

নিজস্ব প্রতিবেদক: আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রস্তাবিত তামাকে কর আরোপ হলে সরকারের প্রায় ৩৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা বেশি। আর এ রাজস্ব আয়ের মাত্র চার দশমিক ৪৫ শতাংশ ব্যয় করলে দেশের সব হৃদরোগীর চিকিৎসা বিনামূল্যে সম্ভব বলে জানিয়েছেন দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোট (বাটা), বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি) ও বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি যৌথভাবে ‘বিনামূল্যে হƒদরোগের চিকিৎসা নিশ্চিতকরণে তামাকজাত দ্রব্যের কর ব্যবস্থাপনা: সম্ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।

বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মোজাফ্ফর হোসেন পল্টুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস এম আব্দুল্লাহ। গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান, বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিপার্টমেন্ট অব ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী। এছাড়া তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিনিধি সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন।

সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ নাগরিকদের বহন করতে হয়। হদরোগের মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসা করতে নাগরিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে কল্যাণকর রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নাগরিকদের কল্যাণে রাষ্ট্র নানা দায়িত্ব নিচ্ছে। হƒদরোগের মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসা বিনামূল্যে নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা দৃষ্টান্ত স্থাপনে কতিপয় প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি। আমাদের প্রস্তাবনা অনুসারে ক্ষতিকর তামাকের ওপর সুনির্দিষ্ট করা আরোপ, এমআরপিতে ক্রেতাদের কাছে সিগারেট বিক্রিয় নিশ্চিত ও সিগারেট কোম্পানিগুলোর কর ফাঁকি রোধ করা সম্ভব হলে প্রায় ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় সম্ভব, যার মাধ্যমে প্রায় ৪১০ কোটি টাকা দিয়ে সব রোগীর হƒদরোগ চিকিৎসা বিনামূল্যে নিশ্চিত করা সম্ভব।

তারা আরও বলেন, আসন্ন অর্থবছরের তামাক কর প্রস্তাবে নি¤œ স্তরের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে সাড়ে ৩২ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ; মধ্যম স্তরের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার খুচরা মূল্য ৭৫ টাকা নির্ধারণ করে ৪৮ টাকা ৭৫ পয়সা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ; উচ্চ স্তরের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার খুচরা মূল্য ১২০ টাকা নির্ধারণ করে ৭৮ টাকা টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ এবং প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের প্রতি ১০ শলাকার খুচরা মূল্য ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৯৭ টাকা ৫০ পয়সা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দেন।

এছাড়া ফিল্টারবিহীন বিড়ির ক্ষেত্রে বাজারে কেবল ২৫ শলাকার বিড়ি রেখে ৮ ও ১২ শলাকার বিড়ি না রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে ২৫ শলাকার খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১১ টাকা ২৫ পয়সা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব দেন। বিপরীতে ফিল্টারযুক্ত বিড়ির ক্ষেত্রে বাজারে ১০ শলাকার বিড়ি না রাখার দাবি জানিয়ে ২০ শলাকার খুচরা মূল্য ২০ টাকা নির্ধারণ করে ৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বাজেট প্রস্তাবে জর্দার ক্ষেত্রে প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে ২৭ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ১৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব জানানো হয়েছে। এছাড়া সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের খুচরা মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আগের মতো বহাল রাখারও প্রস্তাব জানান তারা।

তারা আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো (বিইআর) এবং বিএনটিটিপি পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাজারে সিগারেটের প্যাকেটে মুদ্রিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। ফলে সিগারেট কোম্পানিগুলো অপকৌশলের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

বক্তারা আরও বলেন, হƒদরোগের চিকিৎসার ব্যয়বহুল তিন সেবা এনজিওগ্রাম, স্টেন্টিং (রিং পরানো) ও বাইপাস সার্জারি। দেশে বর্তমানে ২২টি হাসপাতালে এসব চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ রোগী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় হƒদরোগ ইনস্টিটিউট ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে এসব চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকেন। এ তিন হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা এবং খরচের হিসাব কষে দেখা যায় ওই তিনটি সেবা নিতে মোট ব্যয় হয় ২৮৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা তামাক খাত থেকে কাক্সিক্ষত অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের মাত্র তিন দশমিক ১২ শতাংশ। এ রোগীর সংখ্যাকে ৭০ শতাংশ ধরে নিলে দেশের সব হƒদরোগীর অনুরূপ চিকিৎসা নিতে ব্যয় হবে ৫১০ কোটি টাকা, যা ওই অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের চার দশমিক ৪৫ শতাংশ মাত্র।