তামাক চাষের আগ্রাসী বিস্তার ও ব্যবহার থামাতে হবে

মো. জিল্লুর রহমান: প্রতি বছর বাজেটে সিগারেটের ওপর কর বাড়ছে। তাতে অবশ্য ধূমপান আশানুরূপভাবে কমছে না, বরং সিগারেট বিক্রি বাড়ছে। বাড়ছে তামাকের আগ্রাসী চাষও। তামাক এমন একটি ক্ষতিকর উপাদান যেটা শুধু মানুষের শরীরের ক্ষতি করে না, বরং পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি করে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে এবং বিশ্বের শীর্ষ ১০টির মধ্যে ১টি অধিক তামাক ব্যবহারকারী দেশ। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা এবং সার্বিক উন্নয়নে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ‘তামাক’। এ কথা সর্বমহলে স্বীকৃত। তামাক চাষাবাদ, প্রক্রিয়াকরণ ও সেবনসহ প্রতিটি ধাপেই পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, ১৯৭০ সাল থেকে তামাকের কারণে বিশ্বব্যাপী গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে প্রায় ১৫০ কোটি হেক্টর বন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যা ২০ শতাংশ বার্ষিক গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বে বছরে ৩৫ লাখ হেক্টর জমি তামাক চাষে ধ্বংস হয়, যা বৈশ্বিক পাঁচ শতাংশ বনাঞ্চল ধ্বংসের জন্য দায়ী। প্রায় ৯০ শতাংশ তামাক উৎপাদন হয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে তামাকসেবী ছিল ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭তে দেখা যায?, বাংলাদেশে ১৫ বছরের অধিক বয়?সীদের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাকজাত দ্রব্য সেবন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০২২ সালের ‘টোব্যাকো: থ্রেট টু আওয়ার এনভায়রনমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের দেড় কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সিগারেট খান। বিড়ি খান ৫৩ লাখ মানুষ। আর ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন। দেখা যাচ্ছে তামাক সেবনের শতকরা হার নিন্মগামী হয়ে?ছে, যা আশার কথা। পক্ষান্তরে, এমন কিছু অসামঞ্জস্যতা ও প্রতিবন্ধকতা রয়ে?ছে; যা তামাক নিয়?ন্ত্রণে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বিঘœতা সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম তামাক ব্যবহারকারী দেশ। দেশের ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়?স্ক জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার করে। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি ২০১৯-এর তথ্য অনুয়ায?ী, বাংলাদেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। তামাকের জন্য এসব ক্ষতি হলেও দেশের তামাক চাষের এলাকা এবং এর উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ সালে দেশের ৯৯ হাজার ৬০০ একরের বেশি জমিতে তামাকের চাষ হয়। এ সময় ৮৯ হাজার ২ মেট্রিক টন তামাক উৎপাদিত হয়। পরের অর্থবছরে তামাক চাষের জমির এলাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৮৪ একরের বেশি জমি। আর তামাক উৎপাদিত হয় ৯২ হাজার ৩২৬ মেট্রিক টন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে প্রিমিয়াম, উচ্চ, মাঝারি ও নি¤œস্তরের ৭ হাজার ১৫৯ কোটির বেশি সিগারেট শলাকা বিক্রি হয়েছে। পরের বছর তা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৫৬৪ কোটির বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ৫ হাজার ১৯৫ কোটি সিগারেট শলাকা বিক্রি হয়েছে। যদি মাসভিত্তিক হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়, তাতে দেখা যায়, এ বছরও সিগারেটের বিক্রি আগের বছরকে ছাড়িয়ে যাবে। তামাকবিরোধী সংগঠনের মতে, তামাকের ওপর যে হারে কর বাড়ানো হয়, তা যথেষ্ট নয়, কারণ তামাক পণ্য নিত্যপণ্যের দামের তুলনায়? আরও সস্তা হয়ে? পড়?ছে।

তামাক চাষের ফলে পরিবেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে; কারণ তামাক গাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত পদার্থ বের হয়; যা পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি করে। এছাড়া তামাক চাষে প্রচুর সার ও কীটনাশক ব্যবহƒত হয়?, যা মাটি ও পানি দূষণ করে এবং মাছসহ জলাশয়ে?র উদ্ভিদচক্রের মারাত্মক ক্ষতি করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। পাহাড়ে?র ধারে দীর্ঘদিন ধরে তামাক চাষের কারণে তামাকের নির্বাস ও চাষে ব্যবহƒত সার এবং রাসায়?নিক মিশ্রিত পানি সরাসরি গিয়ে? পড়?ছে নদীতে। এতে হালদার পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে এবং মৎস্য প্রজনন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিলুপ্ত হচ্ছে নানা জলজ প্রাণী। তাছাড়?া দেশে ৩১ শতাংশ বন নিধনের ক্ষেত্রে তামাক চাষ দায়?ী। সুতরাং তামাক চাষ ক্রমান্বয়ে? কমিয়ে? আনা এবং নির্দিষ্ট সময়ে?র মধ্যে তামাক চাষ সম্পূর্ণ বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি।

গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, উত্তর অঞ্চলের ফসলি জমিতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে তামাক চাষ বেড়েই চলেছে। সিগারেট কোম্পানির উৎসাহ পেয়ে দিন দিন ধানি ও তিন ফসলি জমিতে চাষিরা তামাক চাষ করছেন। সরকারি বিধি নিষেধের জোরদার না থাকার কারণেই কৃষকরা ফসলি জমিতে খাদ্যশস্য বাদ দিয়ে মরণনাশক তামাক চাষে ঝুঁকেছেন। চরম ক্ষতি জেনেও বেশি মুনাফার লোভে কৃষকরা তামাক চাষে ঝুঁকছেন। নিজস্ব জমি না থাকায় লিজ নিয়ে স্বল্প আয়ের মানুষ অতি লাভের আশায় মরণনাশক তামাক চাষে উৎসাহিত হচ্ছে। আর এতে তাদের উৎসাহ দিচ্ছে কিছু সিগারেট কোম্পানি ও তাদের স্থানীয় এজেন্ট।

জানা যায়, তামাক চাষের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। একই জমিতে কয়েক বছর তামাকের চাষ করার ফলে জমিতে বিশেষ ধরনের আগাছা জন্মে। এ আগাছা জমিতে একবার জন্মালে সে জমিতে আর কখনও অন্য ফসল চাষ করা সম্ভব হয় না। কৃষি অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে নানা ধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের সঙ্গে মাঠ দিবস, পরামর্শ দানসহ বিভিন্ন সময়ে কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু তাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে কৃষকরা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তামাক চাষে ঝুঁকছেন। একজন তামাক চাষির তথ্যমতে, তিনি প্রত্যেক বছর ৭-৮ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেন। তামাকের সঙ্গে অন্যান্য ফসল সামান্য চাষ করেন। তার মতে, তামাক চাষে পরিশ্রম বেশি হলেও দামও বেশি। তিনি মূলত ধানের দাম বেশি না পেয়ে তামাকের চাষে উৎসাহী হচ্ছেন। কারণ তামাক কোম্পানির দেয়া শর্ত মেনে তিনি অগ্রিম সার ও কীটনাশক পেয়েছেন। তাই তামাক চাষ করছেন। জানা যায় পুরুষদের পাশাপাশি নারী-শিশুরাও এসব কাজে জড়িয়ে পড়ছে এবং এটা তাদের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। তাছাড়া তামাক পোড়ানোর জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সহস াধিক চুল্লি বানানো হয়েছে। আর এসব চুল্লিতে ব্যবহার করা হচ্ছে হাজার হাজার টন জ্বালানি কাঠ। তামাক পোড়ানোর ফলে এটা আশপাশের পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। 

তামাক চাষ থেকে বিরত থাকা ভুক্তভোগী চাষিরা বলেন, সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তামাকের চারা রোপণ করে সামান্য পরিচর্যা করলে পরিপক্ব তামাক উৎপাদন করা যায়। এতে বেশ ভালো আয় হয়। কিন্তু তামাক পাতা যখন পরিপক্ব হয় তখন তা তুলে বাড়িতে রাখা হয়। এ সময় শুকনো তামাকের গন্ধে একজন সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ে। এছাড়া তামাকের গন্ধে ক্যান্সারসহ অনেক ধরনের রোগব্যাধি আক্রান্ত হয়। এ সময় শিশু ও নারী তামাক পাতা শুকানোর কাজ করে বলে তারা এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও মাটির গুণাগুণের মারাত্মক ক্ষতির বিষয়?টি কৃষকরা জেনেও উপস্থিত লাভের আশায় বিষাক্ত তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা। এ ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগের উদাসীনতার পাশাপাশি উৎপাদনের আগে কোম্পানি কর্তৃক তামাকের দর নির্ধারণ, বিক্রয়ে?র নিশ্চয়?তা, তামাক চাষের জন্য সুদ মুক্তঋণ বিতরণ, কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়?মিত মাঠ পরিদর্শন ও পরামর্শ দান তামাক চাষ বৃদ্ধির প্রধান কারণ; যা অন্য ফসলের জন্য সরকারিভাবে পান না কৃষক। এতে একদিকে যেমন জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক ও বিস্তার নিয়ে মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস) দীর্ঘদিন আন্দোলন করছে। সংগঠনটি পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর তামাক নিয়ন্ত্রণে আইন সংস্কারের দাবি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে। সুপারিশগুলো হলোÑকৃষিজমি ও পরিবেশ সুরক্ষায়? দ্রুত ‘তামাক চাষ নিয়?ন্ত্রণ নীতি’ পাস করা। কৃষকদের তামাকের বিকল্প ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারি উদ্যোগ নেয়া। তামাক পাতা রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক পুনরায়? আরোপ করা। প্রধানমন্ত্রীর বৃক্ষরোপণে জাতীয়? পদকের জন্য তামাক কোম্পানিকে অযোগ্য ঘোষণা করা। তামাক নিয়?ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে তামাক কোম্পানির ‘সিএসআর’ কর্মসূচি নিষিদ্ধ এবং ‘জাতীয়? তামাক নিয়?ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রণয়?ন করা। ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) থেকে সরকারের ৯.৪৯% শেয়ার এবং কর্মকর্তা প্রত্যাহার করা এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়?ন আইন, নীতিতে তামাক কোম্পানির প্রভাব বন্ধে এফসিটিসি’র অনুচ্ছেদ ৫.৩ অনুসারে ‘গাইডলাইন’ প্রণয়?ন করা। ২০৪০ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়?নে ‘রোডম্যাপ’ চূড?ান্ত করা। তামাক কোম্পানিগুলোর পরিবেশ সুরক্ষার দোহাই দিয়ে? প্রবাহ, সামাজিক বনায়?নের নামে ‘লোক দেখানো নাটক’ বন্ধ করা।

সরকার প্রতিবছর বাজেটে বড় অঙ্কের কৃষি ভর্তুকি প্রদান করে কিন্তু সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে তামাক চাষিরা এসব ভর্তুকি থেকে নানা কারণে বঞ্চিত হয়। সরকারের উচিত এদের কৃষি ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করা। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি এলাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তামাক চাষ না করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেয়া ও তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করা। তামাক পাতা কোনোভাবেই মানুষের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপকার করছে না, এজন্য তামাকবিরোধী আন্দোলনকারীরা বলছেন জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।

ব্যাংকার ও কলাম লেখক

zrbbbpgmail.com