আশিকুর রহমান: তামাক নেশাজাতীয় দ্রব্য যা উৎপাদন থেকে ব্যবহার সব পর্যায়ে মানুষের ক্ষতি করে থাকে। এটির বিষাক্তের রেশ এমন যে, ধূমপায়ী ব্যক্তির আশপাশের লোকজনকেও নিকোটিনের প্রভাবে লিভার ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত করে। বর্তমানে সমাজের আনাচে-কানাচে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের নেশা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিকে রুখে দিতে না পারলে বর্তমান প্রজন্ম থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৪ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক লোক তামাক ব্যবহার করে। অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা) দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায়। এর মধ্যে তামাকের কারণে পঙ্গুত্ব বরণ করে আরও কয়েক লাখ মানুষ। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭ অনুযায়ী, দেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৩৫ শতাংশের বেশি মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। যার মধ্যে ৪৬ শতাংশ পুরুষ ও ২৫ দশমিক ২ শতাংশ নারী, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এমন পরিস্থিতিতে তামাকের কবলে পড়ে যুবসমাজ থেকে শুরু করে ধ্বংস হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষরা। বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন থাকলেও নেই আইনের কঠোর প্রয়োগ। জনসমাগমপূর্ণ এরিয়ায় ধূমপানের শাস্তি থাকলেও অহরহ ধূমপায়ী খোলামেলা জায়গায় ধূমপান করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এমন অবস্থায় বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন কতটা জরুরি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন হয় ২০০৫ সালে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনের তাগিদে তামাকদ্রব্য ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে তামাকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে ২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বেশ কিছু ধারা সংশোধন করে এবং এছাড়া ২০১৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে তামাকের ভয়াবহতা ঠেকাতে এবং আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে প্রস্তাবিত ৭টি বিধি: এক. ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্ত; দুই. বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা; তিন. তামাক কোম্পানির ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি’ নিষিদ্ধ; চার. বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা ও প্যাকেটহীন জর্দা-গুল বিক্রয় নিষিদ্ধ; পাঁচ. ই-সিগারেটসহ সব ইমার্জিং টোব্যাকো প্রডাক্ট আমদানি ও বিক্রয় নিষিদ্ধ; ছয়. তামাক পণ্য মোড়কজাতকরণে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার বৃদ্ধি করে ৯০ শতাংশের বেশি করা; সাত. চলচ্চিত্রে শর্তসাপেক্ষেও ধূমপানের ছবি না দেখানো, উল্লেখিত বিধি জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রণীত বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা নিরসনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও প্রশংসার দাবিদার।
আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী (ধারা : ৫) এ বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার উল্লেখ রয়েছে। আগের আইনে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শনী, চলচিত্র, নাটকে বিভিন্ন দৃশ্য দেখানো গেলেও সংশোধনী প্রস্তাবে এর নিষিদ্ধতা রয়েছে। এতে তামাকসেবীদের মধ্যে প্রদর্শনীর ফলে যে ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হতো সেই কবল থেকে রক্ষা পাবে। ধারা-৬ : এ বর্ণিত প্রস্তাবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির বয়সসীমা বাড়িয়ে অনধিক ২০ বছর করতে হবে যেন তরুণরা তামাকের ব্যবহার থেকে দুরে থাকে। এতে প্রাপ্তবয়স্ক ছাড়া বিড়ি-সিগারেট বিক্রি বন্ধ হবে। ধারা-৭ এ জনসমাগমের স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭ অনুযায়ী, ৪৯.৭ শতাংশ মানুষ হোটেল-রেস্তোরাঁয় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। কর্মক্ষেত্রে তা ৪২.৭ শতাংশ এবং গণপরিবহনে প্রায় ৪৪ শতাংশ। পরোক্ষ ধূমপানে অধূমপায়ীদের হƒদরোগের ঝুঁকি ২৫-৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের ৬৯টি দেশ আচ্ছাদিত জনসমাগমে ধূমপান নিষিদ্ধ করেছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে আগে জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় ধূমপান করলে ৫০ টাকা জরিমানা ছিল পরে তা সংশোধন করে তিনশ টাকা করা হয়েছে। এতেও জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় ধূমপানের উপদ্রব কমেনি। ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান বিলুপ্ত করায় লোকজন যেখানে সেখানে ধূমপান হতে বিরত থাকবে তাই এটির সংশোধন সময়ের দাবি। বিড়ি-সিগারেট, তামাকের সহজলভ্যতায় তরুণ প্রজš§ সহজেই নেশায় জড়িয়ে পড়ে। বন্ধুরা আড্ডায় জমা হলেই দুই একটা সিগারেট কিনে খায় কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাবনায় খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ তরুণদের নেশায় অনীহা সৃষ্টি করবে। এর ফলে তরুণ সমাজ নেশা থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসবে। এছাড়া দেশে ই-সিগারেট আইনে নিষিদ্ধ না হওয়ায় বর্তমানে ই-সিগারেটের প্রচলন যে হারে বাড়ছে, তা কল্পনাতীত। গ্রামের তুলনায় শহর, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এর ব্যবহারের হার বেশি। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ বিশ্বের ৪৭টি দেশে ইলেকট্রনিক সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে। বলবৎ আইন সংশোধন হলে যেমন যুবসমাজকে রক্ষা করা হবে তেমনি রক্ষা পাবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম । তাই ই-সিগারেট এর ব্যবহার ভয়াবহ পর্যায়ে যাওয়ার আগেই এটি নিষিদ্ধ করা জরুরি। তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হলেও তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি (সিএসআর) সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি যার ফলে কোম্পানিগুলো সিএসআরের অজুহাতে নীতিপ্রণেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণে বাধার সৃষ্টি করছে কিন্তু সংশোধনী প্রস্তাবে সিএসআরের নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় তামাক নিয়ন্ত্রণে অপতৎপরতা রুখে দেবে। বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ফলে তামাক কোম্পানিগুলো বিশেষ সুবিধা ও আইনের যেসব ফাঁকফোকর রয়েছে তার সুযোগ নিয়েই ব্যবসা করছে। এতে অবাধে যেমন তামাকের প্রসার ঘটছে তেমনি পঙ্গুত্ব বাড়ছে আনুপাতিক হারে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের দাবি তামাকবিরোধীদের দীর্ঘদিনের কিন্তু এখনও প্রস্তাব হলেও সংসদে পাস হয়নি। তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের ফলে দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ মারা যায়, এই মৃত্যু হ্রাস করতে আইনের সংশোধন জরুরি। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। শুধু আইন সংশোধন করেই নয়, বরং সংশোধিত আইনের কঠোর প্রয়োগও করতে হবে। তবেই বর্তমান আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ বজায় থাকবে। এছাড়া দেশের তামাক সেবনকারীদের ভয়াবহ পরিণতি থেকে রক্ষা করতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন যৌক্তিকতার দাবি রাখে।
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়