তামাক নিয়ন্ত্রণ নয়, চাই তামাকমুক্ত দেশ

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করছে এটা কারোই অজানা নয়। এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, তামাক এমন একটি উপকরণ, যাতে মানুষের ন্যূনতম উপকার নেই। তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত ও ব্যবহারের জন্য যেসব রোগ হয় সেসব-ই প্রাণঘাতী, ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। ওইসব রোগের চিকিৎসা করার সামর্থ্য দেশের অধিকাংশ মানুষের নেই। ধূমপায়ীরা ধূমপানের মাধ্যমে যেমন নিজের ক্ষতি করে, তেমনি আশপাশে থাকা মানুষও এর দ্বারা ক্ষতির শিকার হয়। তামাক ও ধূমপান বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্য যে মারাত্মক হুমকি এটা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এককথায় তামাক প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচ্যিত্রের জন্য হুমকি।

ধূমপানে শরীরের ব্যাপক ক্ষতি সম্পর্কে সবাই জ্ঞাত। এটা ধীরে ধীরে মানুষের জীবনকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। এছাড়া সাধারণ মানুষের চেয়ে ধূমপানকারীদের ফুসফুসের ক্যানসারের হার অনেক বেশি। এক তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থাৎ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করে। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ধূমপানের ফলে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে এবং আরও কয়েক লাখ মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করে। তামাক কোম্পানিগগুলোর দাবি, বছরে ২২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব দেয়, যদিও এই পরিমাণ নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে। তামাক ব্যবহারজনিত রোগব্যাধি ও অকাল মৃত্যুর কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা চিকিৎসা বাবদ ব্যয় হয়। তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের চেয়ে তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু ও অসুস্থতাজনিত আর্থিক ক্ষতি আরও অনেক বেশি। ধূমপান থেকে ধূমপায়ীরা অন্যান্য মাদকের দিকে ধাবিত হয়। এটি ধূমপানের আরও একটি ভয়ংকর দিক। তামাকের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন না হওয়ার ফলে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের মানুষ। তাই তামাক থেকে পাওয়া করের লোভে দেশবাসীকে জিম্মি করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 

২০২৩ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘তামাক নয়, খাদ্য ফলান’। এ প্রতিপাদ্য বোঝা যাচ্ছে, যারা তামাক উৎপাদন করছেন, শুধু তাদের সচেতন করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু যে কৃষক খাদ্য ফলাবেন তাদের জন্য খাদ্য ফলাতে কোনো প্রকার প্রণোদনা নেই। এজন্য খাদ্য ফলাতে কৃষকদের সরাসরি প্রণোদনা ও ভর্তুকি দেয়া দরকার এবং উৎপাদিত খাদ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রয় করতে পারবেন কি না; তার নিশ্চয়তাও দিতে হবে। কারণ মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য ও সংরক্ষণ অপ্রতুলতার অভাবে কৃষক খাদ্য ফলালেও ন্যায্যমূল্যে বিক্রয় করতে পারে না। তাই খাদ্য ফলানোর উৎপাদন ঝুঁকি ও ন্যায্যমূল্যে বিক্রির নিশ্চয়তা নিশ্চিত করাতে সরকারের দায়কে কোনোভাবেই অবজ্ঞা ও অবহেলা করা যায় না। এছাড়া উপরিউক্ত প্রতিপাদ্যে মানুষ হত্যাসহ জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির জন্য তামাক কোম্পানির যেন কোনো প্রকার দায় নেই। তামাক চাষ, উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে সরকারের কোনো প্রকার দায়-দায়িত্বের কথা উল্লেখ নেই, এই বিষয়টি খুবই দুঃখজনক বটে। যদিও প্রফেসর নুরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলায় (রিট পিটিশন নং-১৮২৫/১৯৯৯) [২০ বিএলডি (এইসসিডি) ২০০০ (৩৭৭-৪০৪)] সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে বিদ্যমান তামাকজাত দ্রব্য প্রক্রিয়াকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তামাক ব্যবসা বন্ধ করতে এবং ভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের নিমিত্তে নির্দেশ দানের জন্য যুক্তিসঙ্গত সময় বেঁধে দেবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টোব্যাকো: থ্রেট টু আওয়ার এনভায়রনমেন্ট প্রতিবেদন তথ্য মতে, বাংলাদেশে দেড় কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সিগারেট এবং ৫৩ লাখ মানুষ ধূমপান করে; আর ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্য আরেকটি তথ্য মতেÑবাংলাদেশে প্রতিদিন ১২ কোটি ৩০ লাখ সিগারেট খাওয়া হয় সমপরিমাণ সিগারেটের ফিল্টার আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেয়া হয়। আর প্রতিদিন ৭ কোটি ২০ বিড়ি খাওয়া হয়। অর্থাৎ সমপরিমাণ অবশিষ্টাংশও আবর্জনা হিসেবে যততত্র ফেলা হয়। এই হিসাবে প্রতিদিন সিগারেট-বিড়ি সাড়ে ১৯ কোটি অবশিষ্টাংশ প্রকৃতিতে আবর্জনা আকারে পতিত হচ্ছে এবং মাটি ও পানিতে গিয়ে মিশে গুরুত্বপূর্ণ অণুজীবগুলো ধ্বংস করছে। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে, ২০২১ সালে শুধু বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ৩ হাজার ১৯৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যা মোট অগ্নিকাণ্ডের ১৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০২২ সালে একই কারণে ৩ হাজার ৮৭৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যা প্রায় ২ শতাংশ বেড়ে এই হার ১৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০২১-২০২২ সালে এ সংক্রান্ত অগ্নিদুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে মোট ৪৮ কোটি টাকার বেশি। ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বিড়ি সিগারেটের ফেলে দেয়া জ্বলন্ত টুকরা থেকে ১৭ হাজার ৭৯৭টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে; যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এখানেই শেষ নয়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা টোব্যাকো অ্যাটলাসের তথ্য মতে বাংলাদেশের ৩১ শতাংশ বন ধ্বংসের কারণ তামাক। বনভূমি ধ্বংসের কারণে বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে দক্ষিণ মেরুর বিশাল বরফ খণ্ড গলে যাচ্ছে এবং এতে পৃথিবীর সমুদ্রস্তর ২০ ফুট পর্যন্ত লবণ পানির নিচে চলে যাবে। ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা বলেন, বিশ্বের তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে গেলে দক্ষিণ মেরুর বরফ আরও দ্রুত গলতে শুরু করবে এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অনেক বেড়ে যাবে। বনভূমি সাবাড়ের ফলে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়েছে এবং ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে কানাডায় দাবালনে পুড়ে গেছে লাখ লাখ হেক্টর বনভূমি, যা মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতিরকে অসহনীয় করে তুলেছে। তারপরও পরিবেশদূষণের জন্য তামাক কোম্পানিগুলোকে এখন পর্যন্ত দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। তবু কারও কারও প্ররোচনা ও কূটকৌশলের কারণে তামাক উৎপাদন, ব্যবহার ও বিপণন বন্ধ করতে রাষ্ট্রের কার্যকর পদক্ষেপ নেই। যদিও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের লক্ষ্যে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনীর মাধ্যমে কিছুটা শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সম্প্রতি সরকারের আরেকটি দপ্তর থেকে এই আইনের খসড়া সংশোধনীর বাস্তবায়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব বরাবর একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে।

তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন, বিক্রয় ও বিপণনের বন্ধের জন্য বাংলাদেশে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। যে কারণে বিভিন্ন স্থানে অনিয়ন্ত্রিতভাবে তামাকজাত পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় করা হচ্ছে। বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে সব পাবলিক প্লেসে ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান রাখার বিধান বিলুপ্ত করা; তামাক কোম্পানির কথিত সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা; সব ধরনের খুচরা বা খোলা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করা দরকার। কিন্তু উপরিউক্ত কার্যক্রমে বিভিন্ন প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করতে তামাক কোম্পানিগুলো আইন খসড়ার শুরু থেকেই নানা ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করছে। তামাক কোম্পানিগুলো এবারও আইনের সংশোধনী ঠেকাতে তৎপর হয়ে উঠেছে। তামাক কোম্পানির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে চিঠি দিয়েছে।  

সবার ওপরে জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এজন্য তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু কমাতে শক্তিশালী আইন জরুরি। তামাকের এই ভয়াবহতা রোধে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং এ লক্ষ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন যুগোপযোগী করার নির্দেশ দেন। ওই ঘোষণা বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক। সরকার শুধু তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি আইন জাতীয় সংসদে পাস করেন। কিন্তু তামাক কোম্পানির কূটকৌশলের কারণে এবং সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতির ফলে তামাক চাষ ও তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদন, বিপণন এবং ব্যবহার বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। এসব কার্যক্রম জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের নীতিগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক। তাই ধূমপানের ভয়াবহতা থেকে মানুষকে বাঁচাতেই হলে সরকারকে তামাক উৎপাদন, ব্যবহার ও বিপণন বন্ধের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত কাম্য। এজন্য বর্তমান আইনটি সংশোধন করে তামাক উৎপাদন, ব্যবহার ও বিপণন বন্ধে নিষেধাজ্ঞা কড়াকড়ি করা দরকার।

আইনজীবী

masumbillahlaw06@gmail.com